আকীদাহ্ সম্পর্কিত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলাহ্

আকীদাহ্ সম্পর্কিত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলাহ্
সূচিপত্র
ক্রম বিষয়
১. ভূমিকা
২. ‘আকীদার শাব্দিক বিশ্লেষণ
৩. ‘আকীদার পারিভাষিক অর্থ
৪. আকীদার গুরুত্ব
৫. প্রশ্নোত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
 ভূমিকা
প্রতিটি মুসলিমের জেনে রাখা উচিত যে, আল-কুরআন ও সহীহ সুন্নাহভিত্তিক বিশুদ্ধ ‘আমল ছাড়া অন্যকিছু আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলার নিকট গৃহীত হবে না; আর বিশুদ্ধ ‘আমলের অপরিহার্য পূর্বশর্ত ‘‘ইসলাহুল ‘আকীদাহ বা ‘আকীদাহ্ সংশোধন করা। কারণ বিশুদ্ধ ‘আকীদাহ সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন এবং তা মনে-প্রাণে লালন করা ব্যতীত একজন মুসলিম আপাদমস্তক খাঁটি মুমিন হতে পারবে না। এটা অপ্রিয় সত্য যে, বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমগণ তাওহীদ তথা একত্ববাদ, আল্লাহর পরিচয় ও অবস্থান এবং রিসালাত ও ইসলামের অন্যান্য হুকুম-আহকাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ‘আকীদাহ্ পোষণ করে থাকেন: তাদের এ ভ্রান্ত ধারণা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, ঈমানের অস্তিত্বই হুমকির মুখে নিপতিত হয়েছে। সে সকল বিভ্রান্ত মুসলিম উম্মাহকে সঠিক পথের দিশা দিতে ঈমানী দায়িত্ববোধ থেকেই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের এ প্রয়াসকে কবুল করুন এবং পথহারা পথিককে সিরাতে মুস্তাকিমের দিশা দান করুন। আমীন।

‘আকীদার শাব্দিক বিশ্লেষণ:
كلمة “عقيدة” مأخوذة من العقد والربط والشدّ بقوة، ومنه الإحكام والإبرام، والتماسك والمراصة. (بيان عقيدة أهل السنة والجماعة ولزوم اتباعها 1/4)
‘আকীদাহ্ শব্দটি ‘আক্দ মূলধাতু থেকে গৃহীত। যার অর্থ হচ্ছে, সূদৃঢ়করণ, মজবুত করে বাঁধা। (বায়ানু আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, ১/৪)
‘আকীদার পারিভাষিক অর্থ:
العقيدة الإسلامية: هي الإيمان الجازم بالله، وملائكته، وكتبه، ورسله، واليوم الآخر، والقدر خيره وشره، وبكل ما جاء في القرآن الكريم، والسنة الصحيحة من أصول الدين، وأموره، وأخباره. (رسائل الشيخ محمد بن إبراهيم في العقيدة 7/2).
“শারী‘আতের পরিভাষায় ‘আকীদাহ্ হচ্ছে, মহান আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, শেস দিবস তথা মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় বিষয় ও তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি এবং আল-কুরআনুল হাকীম ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত দীনের সকল মৌলিক বিষয়ের প্রতি অন্তরের সুদৃঢ় মজবুত ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের নাম ‘আকীদাহ।” (রিসালাতুম শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ফিল ‘আকীদাহ্ ৭/২)
‘আকীদার গুরুত্ব:
আকীদার গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এর গুরুত্ব বহনকারী কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো:
১. এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসীগণ প্রশান্তচিত্তের অধিকারী, বিপদে-আপদে, হর্যে-বিষাদে তারা শুধু তাঁকেই আহ্বান করে, পক্ষান্তরে বহু-ঈশ্বরবাদীরা বিপদক্ষণে কাকে ডাকবে, এ সিদ্ধান্ত নিতেই কিংকর্তব্য বিমুঢ়।
২. মহান আল্লাহ সর্বোজ্ঞ, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা সুতরাং তিনি সব জানেন, সব দেখেন এবং সব শোনেন। কোনো কিছুই তাঁর নিকট গোপন নয়-এমন বিশ্বাস যিনি করবেন, তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল পাপ হতে মুক্ত থাকতে পারবেন।
৩. নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের অতি নিকটবর্তী। তিনি দো‘আকারীর দো‘আ কবুল করেন, বিপদগ্রস্তকে বিপদমুক্ত করেন। বিশুদ্ধ ‘আকীদাহ্ বিশ্বাস লালনকারীগণ এটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে সর্বাবস্থায় তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করে। পক্ষান্তরে একাধিক মা‘বুদে বিশ্বাসীগণ দোদুল্যমান অবস্থায় অস্থির-অশান্ত মনে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে।
আমরা এ ক্ষুদ্র পুস্তিকায় মহান আল্লাহর সত্তা সংক্রান্ত এবং তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে যে সকল সুন্দর নাম উন্নত গুণাবলী ও কর্মের কথা ব্যক্ত করেছেন,  তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ।
প্রশ্নোত্তর
১. প্রশ্ন: আল্লাহ কোথায়?
উত্তর: মহান আল্লাহ স্ব-সত্তায় সপ্ত আসমানের উপর অবস্থিত মহান আরশের উপরে আছেন। দলীল: কুরআন, সুন্নাহ ও প্রসিদ্ধ চার ইমামের উক্তি- মহান আল্লাহর বাণী:
﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ ٱسۡتَوَىٰ ٥﴾ [طه: ٥]
“রহমান (পরম দয়াময় আল্লাহ) ‘‘আরশের উপর উঠেছেন।” [সূরা ত্বা-হা: ২০: ৫]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন দাসীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন:
«أَيْنَ اللهُ؟» قَالَتْ: فِي السَّمَاءِ، قَالَ: «مَنْ أَنَا؟» قَالَتْ: أَنْتَ رَسُولُ اللهِ، قَالَ: «أَعْتِقْهَا، فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ»
“আল্লাহ কোথায়? দাসী বলল: আসমানের উপরে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি কে? দাসী বলল: আপনি আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: একে আজাদ (মুক্ত) করে দাও, কেননা সে একজন মুমিনা নারী।” (সহীহ মুসলিম: ১২২৭)

ইমাম আবু হানীফাহ (র)-এর উক্তি:
ইমাম আবু হানীফাহ রহ. বলেন,
«من قال: لا أعرف ربي في السماء أو في الأرض فقد كفر، وكذا من قال: إنه على العرش ولا أدري العرش أفي السماء أو في الأرض، والله تعالى يُدعى من أعلى لا من أسفل» [الفقه الأكبر (1/135)]
“যে ব্যক্তি বলবে, আমি জানি না, আমার রব আসমানে না জমিনে – সে কাফির। অনুরূপ (সেও কাফির) যে বলবে, তিনি আরশে আছেন, তবে আমি জানি না, ‘আরশ আসমানে না জমিনে। (আল ফিকহুল আকবার: ১/১৩৫)
ইমাম মালিক (র)-এর উক্তি:
তার ছাত্র ইয়াহইয়া ইবন ইয়াহইয়া বলেন, একদা আমরা ইমাম মালিক ইবন আনাস রহ. এর কাছে বসা ছিলাম, এমন সময় তার কাছে এক লোক এসে বলল,
«يا أبا عبد الله، (الرحمن على العرش استوى)، كيف استوى؟ قال: فأطرق مالك رأسه، حتى علاه الرحضاء، ثم قال: الاستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة، وما أراك إلا مبتدعاً، فأمر به أن يخرج. وفي رواية: الاستواء معلوم والكيف غير معلوم، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة. [الاعتقاد للبيهقي (1/67)، حاشية السندي على ابن ماجه (1/167)، حاشية السندي على النسائي (6/38)، مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح (2/17، و13/89)]
“হে আবু ‘আব্দুল্লাহ! (মহান আল্লাহ বলেন) ‘‘রহমান (পরম দয়াময় আল্লাহ) ‘আরশের উপর উঠেছেন” (সূরা ত্বাহা: ২০:৫)। এই উপরে উঠা কীভাবে? এর রূপ ও ধরণ কেমন?  প্রশ্নটি শোনামাত্র ইমাম মালিক (র) মাথা নীচু করলেন, এমনকি তিনি ঘর্মাক্ত হলেন: অতঃপর তিনি বললেন: ইসতিওয়া শব্দটির অর্থ (উপরে উঠা) সকলের জানা, কিন্তু এর ধরণ বা রূপ অজানা, এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এর ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা বিদ‘আত। আর আমি তোমাকে বিদ‘আতী ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না। অতঃপর তিনি (র) তাকে মজলিস থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। (ইতিকাদ লিল বাইহাকী ১/৬৭, হাশিয়াতুস সিন্ধী ‘আলা ইবনি মাজাহ ১/১৬৭, মিরকাতুল মাফাতীহ ২/১৭, ১৩/৮৯)।

ইমাম শাফি‘ঈ (র)-এর উক্তি:
«وأن الله على عرشه في سمائه» تهذيب سنن أبي داود، وإيضاح مشكلاته (2/406).
আর নিশ্চয় আল্লাহ আসমানের উপরে স্বীয় আরশের উপর উঠেছেন। (তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬)

ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (র)-এর উক্তি:
মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-কাইসী বলেন, আমি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করলাম,
«يُحكى عن ابن المبارك أنه قيل له: كيف يُعرف ربنا؟ قال: في السماء السابعة على عرشه، قال أحمد: هكذا هو عندنا» تهذيب سنن أبي داود وإيضاح مشكلاته (2/406).
“এ মর্মে ইবনুল মুবারাক (র)-কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘‘আমাদের রবের পরিচয় কীভাবে জানবো? উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘সাত আসমানের উপর ‘আরশে। (এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?) ইমাম আহমাদ (র) বললেন, ‘‘বিষয়টি আমাদের নিকট এ রকমই। (তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬)
উল্লিখিত দলীল-প্রমাণাদি দ্বারা মহান আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
২. প্রশ্ন: মহান আল্লাহ ‘আরশে আযীমের উপরে আছেন-এটা আল-কুরআনের কোন সূরায় বলা হয়েছে?
উত্তর: এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট সাতটি আয়াত রয়েছে:
১. সূরা আল-‘আরাফ ৭:৫৪
২. সূরা ইউনুস ১০:৩
৩. সূরা আর-রা‘দ ১৩:২
৪. সূরা ত্বা-হা ২০:৫
৫. সূরা আল-ফুরকান ২৫:৫৯
৬. সূরা আস-সাজদাহ্ ৩২:৪
৭. সূরা আল-হাদীদ ৫৭:৪
৩. প্রশ্ন : পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, ‘‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন”-[সূরা আল বাকারাহ্ ২:১৫৩], ‘‘আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছে-[সূরা আল-বাকারাহ্ ২:১৯৪), ‘‘আর আমরা গ্রীবাদেশ/শাহারগের থেকেও নিকটে”- [সূরা ক্ব-ফ :১৬], ‘‘যেখানে তিনজন চুপে চুপে কথা বলেন সেখানে চতুর্থজন আল্লাহ” [সূরা আল-মুজাদালাহ্:৭] -তাহলে এই আয়াতগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা কী?
উত্তর: মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতার মাধ্যমে সকল সৃষ্টির সাথে আছেন। অর্থাৎ তিনি সপ্ত আসমানের উপর অবস্থিত ‘আরশের উপর থেকেই সব কিছু দেখছেন, সব কিছু শুনছেন, সকল বিষয়ে জ্ঞাত আছেন। সুতরাং তিনি দূরে থেকেও যেন কাছেই আছেন।
সাথে থাকার অর্থ, গায়ে গায়ে লেগে থাকা নয়। মহান আল্লাহ মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামকে ফির‘আওনের নিকট যেতে বললেন, তারা ফির‘আওনের অত্যাচারের আশংকা ব্যক্ত করলেন। আল্লাহ তাদের সম্বোধন করে বললেন,
﴿قَالَ لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦﴾ [طه: ٤٦]
‘‘তোমরা ভয় পেও না। নিশ্চয় আমি তোমাদের সাথে আছি। (অর্থাৎ) শুনছি এবং দেখছি।” [সূরা ত্ব-হা ২০:৪৬]
এখানে ‘‘সাথে থাকার অর্থ এটা নয় যে, মূসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে মহান আল্লাহ তা‘আলাও ফির‘আওনের দরবারে গিয়েছিলেন। বরং ‘‘সাথে থাকার ব্যাখ্যা তিনি নিজেই করছেন এই বলে যে, ‘‘শুনছি এবং দেখছি।”
অতএব আল্লাহর সাথে ও কাছে থাকার অর্থ হলো জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতার মাধ্যমে, আর স্ব-সত্তায় তিনি ‘আরশের উপর রয়েছেন।
০৪. প্রশ্ন : ‘‘মুমিনের কলবে আল্লাহ থাকেন বা মুমিনের কলব আল্লাহর ‘আরশ’ কথাটির ভিত্তি কী?
উত্তর: কথাটি ভিত্তিহীন, মগজপ্রসূত, কপোলকল্পিত। এর সপক্ষে একটিও আয়াত বা সহীহ হাদীস নেই।
আছে জনৈক কথিত বুজুর্গের উক্তি, (قلب المؤمن عرش الله) ‘‘মুমিনের কলব আল্লাহর ‘আরশ। (আল মাওযূ‘আত লিস্ সাগানী বা সাগানী প্রণীত জাল হাদীসের সমাহার/ভান্ডার- ১/৫০, তাযকিরাতুল মাউযূ‘আত লিল-মাকদিসী ১/৫০)
সাবধান!!! আরবী হলেই কুরআন-হাদীস হয় না। মনে রাখবেন, দীনের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ ব্যতীত বুজুর্গের কথা মূল্যহীন-অচল।
উপরোক্ত উক্তিকারীদের মহান আল্লাহ ও তাঁর মহান ‘আরশের বিশালতা সম্পর্কে ন্যূনতমও ধারণাও নেই। তারা জানেন না যে,  স্রষ্টা সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ করেন না এবং স্রষ্টাকে ধারণ করার মত এত বিশাল কোনো সৃষ্টিও নেই। বর্তমান পৃথিবীতে দেড়শত কোটি মুমিনের দেড়শত কোটি কলব আছে। প্রতি কলবে আল্লাহ থাকলে আল্লাহর সংখ্যা কত হবে? যদি বলা হয় মুমিনের কলব আয়নার মত। তাহলে বলব,  আয়নায় তো ব্যক্তি থাকে না, ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি থাকে। ব্যক্তি থাকার জায়গা আয়না ব্যতীত অপর একটি স্থান।
তবে এ কথা অমোঘ সত্য যে, মুমিনের কলবে মহান আল্লাহর প্রতি ভালবাসা আর আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকারের অদম্য মোহ স্পৃহা থাকে।
﴿وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ حَبَّبَ إِلَيۡكُمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَزَيَّنَهُۥ فِي قُلُوبِكُمۡ﴾ [الحجرات: ٧]
‘‘বরং মহান আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করে তুলেছেন এবং সেটাকে সৌন্দর্য মন্ডিত করেছেন তোমাদের হৃদয়ের গহীনে।” [সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:৭]
০৫. প্রশ্ন : “মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” কথাটা কি সঠিক?
উত্তর: কথাটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, যদি এর দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয় যে, ‘‘স্বয়ং আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” তাহলে সঠিক নয়। আর যদি এর দ্বারা বুঝানো হয় যে, ‘‘মহান আল্লাহর ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান” তাহলে সঠিক; কেননা আমরা জানি আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ওহী প্রেরণ করতে মাধ্যম হিসেবে জিবরীল আলাইহিস সালামকে ব্যবহার করেছেন।
﴿نَزَلَ بِهِ ٱلرُّوحُ ٱلۡأَمِينُ ١٩٣ عَلَىٰ قَلۡبِكَ﴾ [الشعراء: ١٩٣،  ١٩٤]
‘‘এটাকে (কুরআনকে) রুহুল আমীন (জিবরীল) আলাইহিস সালাম আপনার হৃদয়ে অবতীর্ণ করেছেন।” [সূরা আশ-শু‘আরা: ১৯৩-১৯৪]
তিনি নিজেই সর্বত্র বিরাজ করলে মাধ্যমের দরকার হল কেন?
আমরা আরও জানি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে অত্যন্ত নিকট থেকে কথোপকথন করার জন্য মি‘রাজ রজনীতে সাত আসমানের উপর আরোহণ করেছিলেন। [সূরা আন-নাজম ৫৩:০১-১৮]
মহান আল্লাহ যদি সর্বত্রই থাকবেন, তাহলে মিরাজে যাওয়ার প্রয়োজন কী?
অতএব ‘‘মহান আল্লাহ স্ব-সত্তায় সর্বত্র বিরাজমান”এ কথাটি বাতিল, কুরআন-হাদীস পরিপন্থী ও আল্লাহর জন্য মানহানীকর। বরং তাঁর জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান।
০৬. প্রশ্ন: মহান আল্লাহর অবয়ব সম্পর্কে একজন খাঁটি মুসলিমের ‘‘আকীদাহ্-বিশ্বাস কীরূপ হবে। অর্থাৎ মহান আল্লাহর চেহারা বা মুখমন্ডল, হাত, চক্ষু আছে কি? থাকলে তার দলীল প্রমাণ কী?
উত্তর: মহান আল্লাহ মানব জাতিকে আল-কুরআনের মাধ্যমেই পথের দিশা দান করেছেন। আল্লাহ বলেন:
﴿كُلُّ مَنۡ عَلَيۡهَا فَانٖ ٢٦ وَيَبۡقَىٰ وَجۡهُ رَبِّكَ ذُو ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ ٢٧﴾ [الرحمن: ٢٦،  ٢٧]
‘‘(কিয়ামাতের দিন) ভূপৃষ্ঠে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। (হে রাসূল) আপনার রবের মহিমাময় ও মহানুভব চেহারা (সত্তাই) একমাত্র অবশিষ্ট থাকবে।” [সূরা আর-রহমান ৫৫: ২৬-২৭]
এ আয়াতে মহান আল্লাহর চেহারা প্রমাণিত হয়।
মহান আল্লাহর হাত আছে। এর স্বপক্ষে আল কুরআনের দলীল:
﴿قَالَ يَٰٓإِبۡلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسۡجُدَ لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَيَّۖ﴾ [ص: ٧٥]
‘‘আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! আমি নিজ দু’হাতে (আদমকে যাকে সৃষ্টি করেছি, তার সামনে সাজদাহ্ করতে তোমাকে কিসে বাধা দিলো?” [সূরা সাদ ৩৮:৭৫]
অনুরূপ ভাবে মহান আল্লাহর চক্ষু আছে। যেমন: আল্লাহ নবী মূসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন:
﴿وَأَلۡقَيۡتُ عَلَيۡكَ مَحَبَّةٗ مِّنِّي وَلِتُصۡنَعَ عَلَىٰ عَيۡنِيٓ ٣٩ ﴾ [طه: ٣٩]
“আর আমি আমার পক্ষ হতে তোমার প্রতি ভালোবাসা বর্ষণ করেছিলাম, যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।” [সূরা ত্বাহা ২০:৩৯]
তেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন:
﴿وَٱصۡبِرۡ لِحُكۡمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعۡيُنِنَاۖ ﴾ [الطور: ٤٨]
“(হে রাসূল!) আপনি আপনার রবের নির্দেশের কারণে ধৈর্যধারণ করুন, নিশ্চয়ই আপনি আমার চোখেন সামনেই রয়েছেন।” [সূরা আত-তূর  ৫২:৪৮]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
﴿إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعُۢ بَصِيرٌ ١﴾ [المجادلة: ١]
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা শ্রবণ করেন ও দেখেন।” [সূরা আল-মুজা-দালাহ্ ৫৮:১]
উল্লিখিত আয়াতসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, মহান আল্লাহর চেহারা, হাত, চোখ, আছে; তিনি অবয়বহীন নন; বরং তাঁর অবয়ব রয়েছে যদিও আমরা সেটার ধরণ বা রূপ সম্পর্কে কোনো কিছুই জানি না। তবে আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, মহান আল্লাহর শ্রবণ-দর্শন ইত্যাদি মানুষের শ্রবণ-দর্শনের অনুরূপ নয়। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١﴾ [الشورا: ١١]
‘‘আল্লাহর সাদৃশ্য কোনো বস্তুই নেই এবং তিনি শুনেন ও দেখেন।” [সূরা আশ্-শূরা ৪২:১১]
মহান আল্লাহর এ তিনটি গুণাবলীসহ যাবতীয় গুণাবলীর ক্ষেত্রে চারটি বিষয় মনে রাখতে হবে:
১. এগুলো অস্বীকার করা যাবে না
২. অপব্যাখ্যা করা যাবে না
৩. সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া যাবে না এবং
৪. কল্পনায় ধরণ, গঠন আঁকা যাবে না।
০৭. প্রশ্ন : একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ গায়েবের খবর বলতে পারে কী?
উত্তর: অবশ্যই না; একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সৃষ্টির আর কেউ গায়েব এর খবর রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣﴾ [البقرة: ٣٣]
‘‘নিশ্চয়ই আমি (আল্লাহ) আসমান ও জমিনের যাবতীয় গায়েবী বিষয় সম্পর্কে খুব ভালভাবেই অবগত আছি এবং সে সকল বিষয়েও জানি যা তোমরা প্রকাশ করো, আর যা তোমার গোপন রাখো।” [সূরা আল-বাকারাহ্ ২:৩৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿ ۞وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ ﴾ [الانعام: ٥٩]
‘‘সে মহান আল্লাহর কাছে গায়েবী জগতের সকল চাবিকাঠি রয়েছে।” সেগুলো একমাত্র তিনি (আল্লাহ) ছাড়া আর কেউই জানে না।” [সূরা আল-আন‘আম ৬:৫৯]
০৮. প্রশ্ন : আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী গায়েব এর খবর বলতে পারতেন?
উত্তর: আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েবের খবর জানতেন না। তবে মহান আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে যা তাঁকে জানিয়েছেন- তা ব্যতীত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ إِنۡ أَنَا۠ إِلَّا نَذِيرٞ وَبَشِيرٞ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ١٨٨ ﴾ [الاعراف: ١٨٨]
‘‘(হে মুহাম্মাদ!) আপনি ঘোষণা করুণ, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমার কোনোই হাত নেই। আর আমি যদি গায়েব জানতাম, তাহলে বহু কল্যাণ লাভ করতে পারতাম, আর কোনো প্রকার অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করতে পারত না।” [সূরা আল-আ‘রাফ ৭:১৮৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবূওয়াতি জীবনেই এ কথার প্রমাণ মেলে। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যদি গায়েব জানতেন, তাহলে অবশ্যই উহুদের যু্দ্ধ এবং তায়েফসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতেন না।
 যেখানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব রাসূলুল্লাহ (সা) গায়েব জানতেন না, সেখানে অন্য কারো পক্ষেই গায়েব জানা অসম্ভব। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গায়েব জানে না- আর এ সম্পর্কে কারো মনে বিন্দুমাত্রও সংশয় থাকলে, সে স্পষ্ট শির্কের গুনাহে নিমজ্জিত হবে, যা আন্তরিক তাওবাহ্ ছাড়া ক্ষমার অযোগ্য।
০৯. প্রশ্ন: ইহ-জীবনে মুমিন বান্দাদের পক্ষে স্বপ্নযোগে বা স্বচক্ষে মহান আল্লাহর দর্শন লাভ করা সম্ভব কি?
উত্তর: আল-কুরআনের আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, দুনিয়ার জীবনে একনিষ্ঠ মুমিন বান্দাগণও স্বচক্ষে মহান আল্লাহকে দেখতে পাবেন না।
আল্লাহ বলেন:
﴿ قَالَ رَبِّ أَرِنِيٓ أَنظُرۡ إِلَيۡكَۚ قَالَ لَن تَرَىٰنِي﴾ [الاعراف: ١٤٣]
‘‘তিনি (মুসা আলাইহিস সালাম) আল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে আমার রব! তোমার দীদার আমাকে দাও; যেন আমি তোমার দিকে তাকাব। মহান আল্লাহ (মূসাকে) বলেছিলেন, হে মূসা! তুমি আমাকে কখনো দেখতে পাবে না।” [সূরা আল-আ‘রাফ ৭:১৪৩]
এ আয়াতসহ অন্যান্য আয়াত দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সৃষ্টিজীবের কেউ এমনকি নবী রাসূলগণও আল্লাহকে চর্মচক্ষু দ্বারা দুনিয়ার জীবনে দেখতে পান নি। তবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে মহান আল্লাহকে দেখেছেন। (সিলসিলা সহীহাহ্ ৩১৬৯)
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বপ্ন দেখাকে পুঁজি করে যে সকল কথিত পীর-ফকীর মহান আল্লাহকে মুহুর্মূহু দর্শন করার দাবী করেন তা মিথ্যা বৈ কিছু নয়।
আর যারা তাদের এ কথার উপর অণু পরিমাণও বিশ্বাস স্থাপন করবে, তারাও ধোঁকা ও প্রতারণার সাগরে নিমজ্জিত।
১০. প্রশ্ন: কথিত আছে যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ আলাইহিস সালাম নূরের তৈরি। এ কথার কোনো ভিত্তি-প্রমাণ আছে কি?
উত্তর: আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূরের নয়, বরং অন্যান্য মানুষ যেভাবে জন্মলাভ করেন সেভাবে তিনিও জন্মলাভ করেছেন। আর প্রথম মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা মাটি দ্বারা তৈরী করেছেন একজন প্রকৃত মুসলিমকে অবশ্যই এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন:
﴿ قُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ يُوحَىٰٓ إِلَيَّ أَنَّمَآ إِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ﴾ [الكهف: ١١٠]
‘‘(হে রাসূল! আপনার উম্মাতকে) আপনি বলে দিন যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি ওয়াহী নাযিল হয় যে, নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ বা উপাস্য একজনই।” [সূরা আল-কাহাফ ১৮:১১০]
একজন মানুষের যে দৈহিক বা মানসিক চাহিদা রয়েছে, নবী মুহা্ম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরও তেমনি দৈহিক বা মানসিক চাহিদা ছিল। তাই তিনি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাওয়া-দাওয়া, প্রাকৃতিক প্রয়োজন, বিবাহ-শাদী, ঘর-সংসার সবই আমাদের মতই করতেন। পার্থক্য শুধু এখানেই যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রাসূল ছিলেন: তাঁর কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের হিদায়াতের জন্য ওয়াহী নাযিল হত। আর যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অতি প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁকে নূরের নবী বলে আখ্যায়িত করল, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিলো।
এভাবেই একশ্রেণীর মানুষ বলে থাকেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ তা‘আলা আসমান-জমিন, ‘আরশ কুরসী কিছুই সৃষ্টি করতেন না। এ কথাগুলিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও সর্বৈব মিথ্যা। কারণ, কুরআন ও সহীহ হাদীসে এর সপক্ষে কোনোই দলীল-প্রমাণ নেই বরং এ সকল অবান্তর কথাবার্তা আল-কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর পরিপন্থী। অপরদিকে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে,
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]
‘‘আমি জিন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ‘ইবাদত করার জন্য।” [সূরা আয-যারিয়াত ৫১:৫৬)]
১১. প্রশ্ন: অনেকেই এ ‘আকীদাহ্ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যান নি বরং তিনি জীবিত; এ সম্পর্কিত শার‘ঈ বিধান কী?
উত্তর: রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّكَ مَيِّتٞ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ ٣٠﴾ [الزمر: ٣٠]
“নিশ্চয় আপনি মরণশীল এবং তারাও মরণশীল।”
১২. প্রশ্ন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যে সালাত পাঠ করি, তা-কি তাঁর নিকট পৌঁছে?
উত্তর: আমাদের পঠিত সালাত আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা ফেরেশতার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে পৌছান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তোমরা তোমাদের ঘরকে কবর বানিও না এবং আমার কবরকে উৎসবস্থলে পরিণত করো না; আর আমার উপর সালাত পাঠ করো; কেননা, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তোমাদের পঠিত সালাত আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
১৩. প্রশ্ন:  রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা কোনো মৃত বা অনুপস্থিত ওলী-আওলিয়াকে মাধ্যম করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা বা বিপদাপদে সাহায্য চাওয়া যাবে কি?
উত্তর: নবী-রাসূল, ওলী-আওলিয়াসহ সকল সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার কাছেই মানুষ যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার প্রার্থনা করবে। আল্লাহ বলেন:
﴿فَٱبۡتَغُواْ عِندَ ٱللَّهِ ٱلرِّزۡقَ وَٱعۡبُدُوهُ﴾ [العنكبوت: ١٧]
“তোমরা আল্লাহর কাছে (সরাসরি) রিযিক চাও এবং তাঁরই ‘ইবাদাত করো।” [সূরা আল-‘আনকাবূত ২৯:১৭]
﴿ أَمَّن يُجِيبُ ٱلۡمُضۡطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكۡشِفُ ٱلسُّوٓءَ﴾ [النمل: ٦٢]
“বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির ডাকে (আল্লাহ ছাড়া) কে সাড়া দেয়,  যখন সে ডাকে; আর (আল্লাহ ছাড়া) কে তার কষ্ট দূর করে?” [সূরা আন্-নামল ২৭:৬২]
উল্লিখিত আয়াতদ্বয় ছাড়াও আল-কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, আল্লাহ ছাড়া মৃত বা অনুপস্থিত কোনো ওলী-আওলিয়া, পীর-মাশায়েখ এমনকি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, নবীকুল শিরোমণি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও মাধ্যম করে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া জায়েয নয়। পক্ষান্তরে মানুষের যা কিছু চাওয়া-পাওয়া রয়েছে, তা সরাসরি আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ عِبَادٌ أَمۡثَالُكُمۡۖ ﴾ [الاعراف: ١٩٤]
‘‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাকো, তারা তো সবাই তোমাদের মতই বান্দা।” [সূরা আল-আ‘রাফ ৭:১৯৪]
﴿ أَمۡوَٰتٌ غَيۡرُ أَحۡيَآءٖۖ وَمَا يَشۡعُرُونَ أَيَّانَ يُبۡعَثُونَ ٢١ ﴾ [النحل: ٢١]
‘‘তারা তো মৃত, প্রাণহীন এবং তাদেরকে কবে পুনরূত্থান করা হবে তারা তাও জানে না।” [সূরা আন-নাহল ১৬:২১]
এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচাতো ভাই ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাসকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘যখন তুমি কোনো কিছু চাইবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছে চাইবে। আর যখন তুমি কোনো সাহায্য চাইবে, তখনও একমাত্র মহান আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে।” এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও আল্লাহর কাছেই তা চাইতে বলা হয়েছে।
১৪. প্রশ্ন: উপস্থিত জীবিত ব্যক্তিদের কাছে সাহায্য চাওয়া সম্পর্কিত শরী‘আতের বিধান কী?
উত্তর: উপস্থিত জীবিত ব্যক্তি যে সমস্ত বিষয়ে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন, সে সমস্ত বিষয়ে তার কাছে চাওয়া যাবে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿فَٱسۡتَغَٰثَهُ ٱلَّذِي مِن شِيعَتِهِۦ عَلَى ٱلَّذِي مِنۡ عَدُوِّهِۦ فَوَكَزَهُۥ مُوسَىٰ فَقَضَىٰ عَلَيۡهِۖ﴾ [القصص: ١٥]
‘‘মূসা (আ)-এর দলের লোকটি তার শত্রুর বিরুদ্ধে মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল, তখন মূসা আলাইহিস সালাম তাকে ঘুষি মারলেন, এভাবে তিনি তাকে হত্যা করলেন।” [সূরা আল-ক্বাসাস ২৮:১৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ ﴾ [المائ‍دة: ٢]
“তোমরা পূণ্য তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সাহায্য করো। তবে পাপকার্যে ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে তোমরা একে অপরকে সাহায্য করো না।” [সূরা আল মায়িদাহ্ ৫:২]
এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কোনো বান্দা যতক্ষণ তার ভাইদের সাহায্যে নিয়োজিত থাকবে, ততক্ষণ আল্লাহ সে  বান্দার সাহায্যে নিয়োজিত থাকবেন।” (মুসলিম)
উল্লেখিত দলীল-প্রমাণাদি দ্বারা বুঝা যায় যে, জীবিত ব্যক্তিগণ পারস্পরিক সাহায্য চাইলে, তা শরীয়াসম্মত।
১৫. প্রশ্ন : মহান আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মনে প্রাণে ভালোবাসা ও আনুগত্য করার উত্তম পদ্ধতি কী?
উত্তর: মহান আল্লাহকে মনেপ্রাণে ভালোবাসার উত্তম পদ্ধতি হলো-খালেস অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার যাবতীয় হুকুম-আহকাম দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নিয়ে তাঁর আনুগত্য করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিপূর্ণ অনুসরণ করা। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١ ﴾ [ال عمران: ٣١]
“(হে রাসূল! আপনার উম্মাতকে) আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তবে আমারই অনুসরণ করো: তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন, আর তোমাদের অপরাধও ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” [সূরা আল-‘ইমরান ৩:৩১]
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মনেপ্রাণে ভালোবাসার উত্তম পদ্ধতি হলো: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যেকটি সুন্নাতকে দ্বিধাহীনচিত্তে যথাযথভাবে অন্তর দিয়ে ভালোবাসা, আর সাধ্যানুযায়ী ‘আমল করার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء: ٦٥]
‘‘অতএব (হে মুহাম্মাদ!) আপনার রবের কসম! তারা কখনই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের মাঝে সৃষ্ট কোনো ঝগড়া-বিবাদের ব্যাপারে তারা আপনাকে ন্যায়বিচারক হিসেবে মেনে নিবে। অতঃপর তারা আপনার ফায়সালার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা রাখবে না এবং তা শান্তিপূর্ণভাবে কবূল করে নিবে।” [সূরা আন্-নিসা ৪:৬৫]
১৬. প্রশ্ন: বিদ‘আতের পরিচয় এবং বিদ‘আতী কাজের পরিণতি সম্পর্কে শরী‘আতের ফায়সালা কী?
উত্তর: সাধারণ অর্থে সুন্নাতের বিপরীত বিষয়কে বিদ‘আত বলা হয়। আর শার‘ঈ অর্থে বিদআত হলো: ‘‘আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে ধর্মের নামে নতুন কোনো প্রথা বা ‘ইবাদাতের প্রচলন করা, যা শরী‘আতের কোনো সহীহ দলীল-প্রমাণের উপর ভিত্তিশীল নয়।” (আল ই‘তিসাম ১/১৩ পৃষ্ঠা)।
বিদ‘আতীর কাজের পরিণতি ৩টি:
১. ঐ বিদ‘আতী কাজ বা আমল আল্লাহর দরবারে কখনোই গৃহীত হবে না।
২. বিদ‘আতী কাজ বা আমলের ফলে মুসলিম সমাজে গোমরাহী বিস্তার লাভ করে এবং
৩. এ গোমরাহীর চূড়ান্ত ফলাফল বা পরিণতি হলো, বিদ‘আত কার্য সম্পাদনকারীকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের শারী‘আতে এমন নতুন কিছু সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী ও মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, “আর তোমরা দীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করা হতে সাবধান থেকো! নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সংযোজন বিদ‘আত, আর প্রত্যেকটি বিদ‘আত গোমরাহীর পথনির্দেশ করে, আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম হলো জাহান্নাম।” (আহমাদ, আবূ দাঊদ, আত্ তিরমিযী)
১৭. প্রশ্ন : আমাদের দেশে বড় ধরনের এমন কি বিদ‘আতী কাজ সংঘটিত হচ্ছে-যার সাথে শরী‘আতের কোনো সম্পর্ক নেই?
উত্তর: একজন খাঁটি মুসলিম কোনো আমল সম্পাদনের পূর্বে অবশ্যই পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখবে যে, তার কৃত আমলটি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত কি-না। কিন্তু আমাদের দেশের সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষ এমন অনেক কাজ বা আমলের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছেন, যার সাথে শরী‘আতে মুহাম্মাদীর কোনোই সম্পর্কে নেই। এমন উল্লেখযোগ্য বিদ‘আত হলো:
১. ‘মীলাদ মাহফিল-এর অনুষ্ঠান করা।
২. ‘শবে বরাত’ পালন করা।
৩. ‘শবে মিরাজ উদযাপন করা।
৪. মৃত ব্যক্তির কাযা বা ছুটে যাওয়া নামাযসমূহের কাফ্ফারা আদায় করা।
৫. মৃত্যুর পর তৃতীয়, সপ্তম, দশম এবং চল্লিশতম দিনে খাওয়া-দাওয়া ও দো‘আর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
৬. ইসালে সাওযাব বা সাওয়াব রেসানী বা সাওয়াব বখশে দেওয়ার অনুষ্ঠান করা।
৭. মৃত ব্যক্তির রূহের মাগফিরাতের জন্য অথবা কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশে খতমে কুরআন অথবা খতমে জালালীর অনুষ্ঠান করা।
৮. উচ্চকণ্ঠে বা চিৎকার করে যিকর করা।
৯. হালকায়ে যিকরের অনুষ্ঠান করা।
১০. মনগড়া তরীকায় পীরের মূরীদ হওয়া।
১১. ফরয, সুন্নাত, নফল ইত্যাদি সালাত শুরু করার পূর্বে মুখে উচ্চারণ করে নিয়্যাত পড়া।
১২. প্রস্রাব করার পরে পানি থাকা সত্ত্বেও অধিকতর পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে কুলুখ নিয়ে ২০/৪০/৭০ কদম হাঁটাহাঁটি করা বা জোরে কাশি দেয়া অথবা উভয় পায়ে কেঁচি দেওয়া, যা বিদ‘আত হওয়ার পাশাপাশি বেহায়াপনাও বটে।
১৩. ৩টি অথবা ৭টি চিল্লা দিলে ১ হাজ্জের সাওয়াব হবে- এমনটি মনে করা।
১৪. সম্মিলিত যিকর ও যিকরে নানা অঙ্গভঙ্গি করা।
১৫. সর্বোত্তম যিকর ‘‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ”-কে সংকুচিত করে শুধু আল্লাহ, আল্লাহ বা হু, হু করা ইত্যাদি।
উল্লিখিত কার্যসমূহ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এমনকি মহামতি ইমাম চতুষ্টয়েরও আমলের অন্তর্ভুক্ত ছিল না এবং কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিতও নয়। সুতরাং এ সবই বিদ‘আত, যা মানুষকে পথভ্রষ্টতার দিকে পরিচালিত করে- যার চূড়ান্ত পরিণতি জাহান্নামের আযাব ভোগ করা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এসব বিদ্আতী কর্মকাণ্ড হতে হিফাযত করুন-আমীন।
১৮. প্রশ্ন: মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস বলে মানুষের মাঝে বর্ণনা করা বা বই-পুস্তকে লিখে প্রচার করার পরিণতি কী?
উত্তর: যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীস রচনা করে মানুষের কাছে বর্ণনা করে তার পরিণতি জাহান্নাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার নামে মিথ্যা বলবে, তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম।” (বুখারী ১/৫২, মুসলিম-১/৯)
১৯. প্রশ্ন: আমরা সাধারণত ‘ইবাদাত বলতে বুঝি কালেমাহ্, সালাত, যাকাত, সওম ও হাজ্জ ইত্যাদি। মূলত ‘ইবাদাতের সীমা-পরিসীমা কতটুকু?
উত্তর: ‘‘ইবাদাত অর্থই হচ্ছে প্রকাশ্য এবং গোপনীয় ঐ সকল কাজ ও কথা, যা আল্লাহ তা‘আলা ভালোবাসেন বা যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
ইবাদাতের উল্লিখিত সংজ্ঞা থেকেই বুঝা যায় যে, ‘‘ইবাদাত শুধুমাত্র কালেমাহ, সালাত, যাকাত, সওম ও হাজ্জ ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণে আল্লাহর ‘ইবাদাত নিহিত রয়েছে। আল্লাহ বলেন:
﴿قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ ﴾ [الانعام: ١٦٢]
“(হে রাসূল !) আপনি বলে দিন যে, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানী এবং আমর জীবন ও মরণ সবকিছুই মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত যিনি সমগ্র বিশ্বের রব্ব।” [সূরা আল-আন‘আম ৬:১৬২]
এ আয়াত এটাই প্রমাণ করে যে, মানব জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের ভাল কথা বা কাজ ‘ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। যেমন- দো‘আ করা, বিনয় ও নম্রতার সাথে ‘ইবাদাত করা, হালাল উপার্জন করা ও হালাল খাওয়া, দান-খায়রাত করা, পিতা-মাতার সেবা করা, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করা, সর্বাবস্থায় সত্যাশ্রয়ী হওয়া, মিথ্যা বর্জন করা ইত্যাদি ‘ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত।
২০. প্রশ্ন : কোন পাপ কর্মটি মহান আল্লাহুর কাছে সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয় এবং সর্ববৃহৎ পাপ বলে গণ্য হবে?
উত্তর: মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয় এবং সর্ববৃহৎ পাপ বলে গণ্য হবে শির্কের গুনাহসমূহ। মহান আল্লাহ এ গুনাহ থেকে বিরত থাকতে তাঁর বান্দাকে বারংবার সতর্ক করেছেন।
﴿ وَإِذۡ قَالَ لُقۡمَٰنُ لِٱبۡنِهِۦ وَهُوَ يَعِظُهُۥ يَٰبُنَيَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣﴾ [لقمان: ١٣]
‘‘লোকমান আলাইহিস সালাম তাঁর ছোট্ট ছেলেটিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, হে আমার ছেলে! তুমি আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করবে না। কেননা শিরক হলো সবচেয়ে বড় যুলম (অর্থাৎ বড় পাপের কাজ)।” [সূরা লুকমান: ৩১:১৩]
২১. প্রশ্ন : শিরক কী? বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত এমন কাজসমূহই বা কী?
উত্তর: আরবী শিরক শব্দের অর্থ অংশী স্থাপন করা। পারিভাষিক অর্থে শিরক বলা হয়- কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা বা তাঁর ইবাদাতে অন্য কাউকে শরীক করা। বড় শিরক হলো: সকলপ্রকার ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্যেই নিবেদিত; কিন্তু সে ইবাদাতে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে শরীক করা বড় শির্কের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ ছাড়া কোনো পীর-ফকীর বা ওলী-আওলিয়াদের কাছে সন্তান চাওয়া, ব্যবসায়-বাণিজ্যে আয়-উন্নতির জন্যে অথবা কোনো বিপদ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে কোনো পীর-ফকীরের নামে বা মাযারে মান্নত দেওয়া, সাজদাহ করা, পশু যবেহ করা ইত্যাদি বড় শিরক বলে গণ্য হবে। আল্লাহ বলেন:
﴿ وَلَا تَدۡعُ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَۖ فَإِن فَعَلۡتَ فَإِنَّكَ إِذٗا مِّنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٠٦ ﴾ [يونس: ١٠٦]
“(হে মুহাম্মাদ) আপনি আল্লাহ ব্যতীত এমন কোনো কিছুর নিকট প্রার্থনা করবেন না, যা আপনার কোনো প্রকার ভালো বা মন্দ করার ক্ষমতা রাখে না। কাজেই হে নবী! আপনি যদি এমন কাজ করেন, তাহলে আপনিও যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন।” ([সূরা ইউনুস ১০:১০৬]
বড় শিরকের সংখ্যা নির্ধারিত নেই; তবে বড় শিরকের শাখা-প্রশাখা অনেক। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া।
২. একক আল্লাহ ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য পশু যবেহ করা।
৩. আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মানৎ করা।
৪. কবরবাসীর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কবরের চারপাশে তাওয়াফ করা ও কবরের পাশে বসা।
৫. বিপদে-আপদে আল্লাহ ছাড়া অন্যের অন্যের উপর ভরসা করা। ইত্যাদি ছাড়াও এ জাতীয় আরো অনেক শিরক রয়েছে। যা বড় শিরক হিসেবে গণ্য হবে।
২২. প্রশ্ন: বড় শিরকের পরিণতি কী হতে পারে?
উত্তর: বড় শিরকের দ্বারা মানুষের সৎ ‘আমলসমূহ নষ্ট হয়ে যায়, জান্নাত হারাম হয়ে যায় এবং চিরস্থায়ী ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারিত হয়। আর তার জন্যে পরকালে কোনো সাহায্যকারী থাকে না। আল্লাহ বলেন:
﴿وَلَقَدۡ أُوحِيَ إِلَيۡكَ وَإِلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكَ لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٥ ﴾ [الزمر: ٦٥]
“(হে নবী! আপনি যদি শিরক করেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনার ‘আমলসমূহ নষ্ট হয়ে যাবে। আর আপনি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন।” [সূরা আয-যুমার ৩৯:৬৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ أَنصَارٖ ٧٢ ﴾ [المائ‍دة: ٧٢]
“নিশ্চয়ই যে আল্লাহর সাথে অন্যকে অংশীদার বানায়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন, তার চিরস্থায়ী বাসস্থান হবে জাহান্নাম। এ সমস্ত যালিম তথা মুশরিকদের জন্য কিয়ামাতের দিন কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।” [সূরা আল-মায়িদাহ্ ৫:৭২]
আল্লাহ ইচ্ছা করলে যে কোনো গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন, কিন্তু শিরকের গুনাহ (তাওবাহ ব্যতীত মৃত্যুবরণ করলে) কখনো মাফ করবেন না। শির্কের গুনাহের চূড়ান্ত পরিণতি স্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধিভূত হওয়া।
২৩. প্রশ্ন:  আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে অর্থাৎ পীর-ফকীর, ওলী-আওলিয়ার নামে বা মাযারে মানৎ করার শার‘ঈ বিধান কী?
উত্তর: একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে মানৎ করা যাবে না। কারণ নযর বা মানৎ একটি ইবাদাত আর সকল প্রকার ইবাদাত কেবলমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত; কোনো নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম বা পীর-ফকীর, ওলী-আওলিয়া অথবা মাযারে নযর বা মান্নত করা যাবে না, করলে তা শিরকী কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে নযর বা মান্নত করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ إِذۡ قَالَتِ ٱمۡرَأَتُ عِمۡرَٰنَ رَبِّ إِنِّي نَذَرۡتُ لَكَ مَا فِي بَطۡنِي مُحَرَّرٗا فَتَقَبَّلۡ مِنِّيٓۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٣٥﴾ [ال عمران: ٣٥]
‘‘(ইমরানের স্ত্রী বিবি হান্নাহ) আল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হে আমার রব! আমার পেটে যে সন্তান আছে তা আমি কুক্ত করে আপনার উদ্দেশ্যে মান্নত করেছি।” [সূরা আল-‘ইমরান ৩:৩৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿ يُوفُونَ بِٱلنَّذۡرِ وَيَخَافُونَ يَوۡمٗا كَانَ شَرُّهُۥ مُسۡتَطِيرٗا ٧ ﴾ [الانسان: ٧]
“তারা যেন মান্নত পূর্ণ করে এবং সেদিনের ভয় করে যেদিনের বিপর্যয় অত্যন্ত ব্যাপক।” [সূরা আদ্-দাহর ৭৬:৭]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের কাজে মান্নত করে সে যেন তা পূর্ণ করার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মান্নত করে সে যেন তাঁর নাফরমানী না করে- (অর্থাৎ মান্নত যেন আদায় না করে)।” (বুখারী ৬৬৯৬, ৬৭০০; আবু দাঊদ ৩২৮৯)
আল্লাহ ব্যতীত গাইরুল্লাহ বা অন্যের নামে মান্নত করার অর্থ হলো, গাইরুল্লাহরই ইবাদাত করা যা বড় শিরক বলে গণ্য হবে।
২৪. প্রশ্ন: কবর বা মাযারে গিয়ে কবরবাসীর কাছে কিছু প্রার্থনা করা যাবে কী?
উত্তর: কবরে বা মাযারে গিয়ে কিছু প্রার্থনা করা শির্ক। কারণ, কবরবাসীর কোনোই ক্ষমতা নেই যে, সে কারো কোনো উপকার করবে। বরং দুনিয়ার কোনো আহ্বানই সে শুনতে পায় না। আল্লাহ বলেন:
﴿ فَإِنَّكَ لَا تُسۡمِعُ ٱلۡمَوۡتَىٰ﴾ [الروم: ٥٢]
‘‘(হে নবী!) নিশ্চয়ই আপনি মৃতকে শুনাতে পারবেন না।”[সূরা আর-রূম ৩০:৫২]
২৫. প্রশ্ন : কবরমুখী হয়ে অথবা কবরের পাশে সালাত আদায় করার শার‘ঈ হুকুম কী?
উত্তর: কবরমুখী হয়ে অথবা কবরকে কেন্দ্র করে তার পার্শ্বে সালাত আদায় করা শির্ক এবং তা কখনোই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
 «ولا تصلوا إلى القبور»
“তোমরা কবরের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করবে না।” (সহীহ মুসলিম হা: ৯৮)
বাংলাদেশে ওলী-আওলিয়াদের কবরকে কেন্দ্র করে অনেক মসজিদে নির্মিত হয়েছে। ঐ সকল কবরকেন্দ্রীক মসজিদে সালাত আদায় করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে বলেছেন: “ইয়াহূদী নাসারাদের উপর আল্লাহ অভিসম্পাত। কারণ তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে। (বুখারী-৩৪৫৩, ১৩৯০; মুসলিম- ৫২৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারী মহিলাদেরকে এবং যারা কবরকে  মসজিদে পরিণত করে, আর তাতে বাতি জ্বালায়, তাদের উপর অভিসম্পাত করেছেন। (আবু দাউদ ৩২৩৬; তিরমিযী-৩২; নাসায়ী-২০৪)
অন্যান্য দলীল প্রমাণ একত্রিত করলে মহিলাদের কবর যিয়ারতের বিষয় দাঁড়ায় নিম্নরূপ:
১. যদি মহিলাদের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য হয়, মৃত্যুর কথা ও আখিরাতের কথা স্মরণ করা এবং যাবতীয় হারাম কর্ম থেকে বিরত থাকা তাহলে জায়েয।
২. আর যদি এমন হয় যে, দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে যেমন-প্রতি ঈদে, প্রতি সোমবার, প্রতি শুক্রবার যিয়ারত করা বিদ‘আত। সেখানে গিয়ে তারা বিলাপ করবে, উঁচু আওয়াজে কান্না-কাটি করবে, পর্দার খেলাফ কাজ করবে, সুগন্ধি বা সুগন্ধযুক্ত কসমেটিক ব্যবহার করে বেপর্দা বেশে কবর যিয়ারত হারাম। শিরক-বিদ‘আতে জড়িয়ে পড়বে, অক্ষম, অসহায়, অপারগ মৃত কথিত অলী-আওলিয়াদের কাছে বিপদ মুক্তি চাইলে। মনের কামনা-বাসনা পূরণ করণার্থে চাইবে তাহলে তাদের জন্য কবর যিয়ারত হারাম। দলীলসহ বিস্তারিত দেখুন সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৬৬৮-৬৬৯ পৃষ্ঠা।
২৬. প্রশ্ন: আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট সন্তান কামনা করা যাবে কী?
উত্তর: সন্তান দেওয়া, না দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। এতে অন্য কারোও কোনো ক্ষমতা নেই। সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে কোনো পীর-ফকীর, দরবেশ, ওলী-আওলিয়া বা মাযারে গিয়ে আবেদন নিবেদন করা, নযর মানা ইত্যাদি শির্কের অন্তর্ভুক্ত; যা (ক্ষমা না চাইলে) সাধারণ ক্ষমার অযোগ্য পাপ। সন্তান দানের মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। আল-কুরআন সাক্ষ্য দিচ্ছে:
﴿يَهَبُ لِمَن يَشَآءُ إِنَٰثٗا وَيَهَبُ لِمَن يَشَآءُ ٱلذُّكُورَ ٤٩ أَوۡ يُزَوِّجُهُمۡ ذُكۡرَانٗا وَإِنَٰثٗاۖ وَيَجۡعَلُ مَن يَشَآءُ عَقِيمًاۚ﴾ [الشورا: ٤٩،  ٥٠]
‘‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা ছেলে-মেয়ে উভয়ই দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছে বন্ধ্যা করেন।” [সূরা আশ্শূরা ৪২:৫০]
তাই নবী-রাসূলগণ যেমন; জাতির পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও যাকারিয়া আলাইহিস সালাম একমাত্র আল্লাহর কাছেই সন্তানের প্রার্থনা করতে করাতে সুদীর্ঘ দিন পর তাদেরকে আল্লাহ সন্তান দান করেন। সন্তান না হলে সুদীর্ঘকাল যাবৎ নবীগণ আল্লাহর কাছে চান, আর উম্মাতগণ পীর-ফকীর নামে তথাকথিত মানুষের কাছে চায়। এরা কি নবীগণের আদর্শ থেকে বিচ্যুত নয়?
২৭. প্রশ্ন : আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে কুরবানী বা পশু যবেহ করলে, তার শার‘ঈ হুকুম কী?
উত্তর: আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে কুরবানী করা সুস্পষ্ট শির্ক। আল্লাহর নামের সাথে কোনো পীর-ওলী, গাউস-কুতুবের নাম উচ্চারণ করাও শিরক। কুরবানী বা পশু যবেহ করতে হবে একমাত্র আল্লাহর নামে। আল্লাহ বলেন
﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ٢ ﴾ [الكوثر: ٢]
‘‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং নাহর (কুরবানী) করুন।” [সূরা আল-কাওসার ১০৮:২)]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ঐ ব্যক্তির উপর আল্লাহ অভিশাপ, যে আল্লাহ ব্যতীত গাইরুল্লাহর নামে যবেহ করে।” (সহীহ মুসলিম হা: ১৯৭৮)
“আল্লাহ ব্যতীত গাইরুল্লাহর নামে যবেহকৃত পশুর গোশত খাওয়া হারাম।”[সূরা আল-মায়িদাহ ৫:৩]
২৮. প্রশ্ন : আল্লাহর যিকরের সাথে অন্য কারো নাম যুক্ত করার শার‘ঈ হুকুম কী?
উত্তর: আল্লাহর যিকরের সাথে অন্য কারো নাম যুক্ত করা শির্ক। যেমন, অনেক মাযারভক্ত ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ” ইয়া নূরে খোদা অথবা হক্ক বাবা, হায়রে খাজা বলে যিকর করে- যা সম্পূর্ণরূপে শির্ক। কারণ ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হতে হবে। আল্লাহ বলেন:
﴿وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن يَدۡعُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسۡتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَآئِهِمۡ غَٰفِلُونَ ٥ ﴾ [الاحقاف: ٥]
“তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে আল্লাহকে ছেড়ে এমন সত্তাকে ডাকে, যে কিয়ামাত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিতে পারবে না।” [সূরা আল-আহকাফ ৪৬:৫]
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর যিকরের সাথে অন্য কারো নাম যুক্ত করার অর্থ হলো: তাকেও আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা। কিন্তু একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এবং সকল কিছুই তাঁর সৃষ্টি। সুতরাং সৃষ্টি ও স্রষ্টা কখনোই এক হতে পারে না। আল কুরআন সাক্ষী দিচ্ছে:
﴿ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ ٤ ﴾ [الاخلاص: ٤]
‘‘এবং কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়।” [সূরা আল-ইখলাস ১১২:৪]
২৯. প্রশ্ন: একজন প্রকৃত মুসলিমের একমাত্র ভরসাস্থল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা- এ ‘আকীদাহ্-বিশ্বাসের বিপরীত কোনো চিন্তার সুযোগ আছে কী?
উত্তর: একজন প্রকৃত মুসলিম সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার উপর তাওয়াক্কুল করবে, আল কুরআন সে শিক্ষাই দিচ্ছে। এ বিপরীত চিন্তা লালন করা শিরকের পর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ বলেন:
﴿وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٢٣ ﴾ [المائ‍دة: ٢٣]
‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাকো, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো।” [সূরা আল-মায়িদাহ্ ৫:২৩]
﴿وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ﴾ [الطلاق: ٣]
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট।” [সূরা আত-ত্বালাক ৬৫:৩]
﴿ وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱلۡحَيِّ ٱلَّذِي لَا يَمُوتُ﴾ [الفرقان: ٥٧]
‘‘তুমি ভরসা করো সেই চিরঞ্জীবের উপর, যার মৃত্যু নেই।” [সূরা আল ফুরকান ২৫:৫৮]
৩০. প্রশ্ন: যাদু সম্পর্কিত শার‘ঈ হুকুম কী এবং যাদুকরের শাস্তি কী?
উত্তর: যাদু সম্পর্কিত বিধান হলো: এটি কাবীরাহ্ গুনাহ এবং ক্ষেত্র বিশেষে কুফরী। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাদুকর কখনো মুশরিক, কখনো কাফির, আবার কখনো ফিতনাহ সৃষ্টিকারী হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَٰكِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ ٱلنَّاسَ ٱلسِّحۡرَ﴾ [البقرة: ١٠٢]
‘‘কিন্তু শয়তান কুফরী করেছিল, তারা মানুষদেরকে জাদুবিদ্যা শিক্ষা দিত।” [সূরা আল-বাকারাহ্ ২:১০২]
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুসলিম গভর্নরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় লিখেছেন: ‘‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা করো।” (সহীহ বুখারী হা: ৩১৫৬; সুনান আবু দাউদ হা: ৩০৪৩)
জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ হাদীসে বর্ণিত আছে- “যাদুকরের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।” (জামে তিরমিযী হা: ১৪৬)
৩১. প্রশ্ন : গণক ও জ্যোতিষীরা গায়েবের খবর সম্পর্কে অনেক কথা বলে থাকে; গণক ও জ্যোতিষীদের ঐসব কথা বিশ্বাস করা যাবে কী এবং এর শার‘ঈ বিধান কী?
উত্তর: গণক বা জ্যোতিষী তো দূরের কথা, নবী-রাসূলগণও গায়েব সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿قُل لَّا يَعۡلَمُ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ٱلۡغَيۡبَ إِلَّا ٱللَّهُۚ﴾ [النمل: ٦٥]
“(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া আসমান ও যমীনে আর যারা আছে তাদের কেউই গায়েবের খবর জানে না।” [সূরা আন-নামল ২৭:৬৫]
এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি গণক ও জ্যোতিষীদের নিকট গেল অতঃপর তারা যা বলল, তা বিশ্বাস করল, সে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ কুরআনুল হাকীমের সাথে কুফরী করল (পক্ষান্তরে সে আল্লাকেই অস্বীকার করল)। (সুনান আবূ দাঊদ ৩৯০৪)
“যে ব্যক্তি কোনো গণক তথা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে গেল,  অতঃপর তাকে (ভাগ্য সম্পর্কে) কিছু জিজ্ঞেস করল- চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবূল হবে না।” (সহীহ মুসলিম ২২৩; মুসনাদ আহমাদ ৪/৬৭)
গণক বা জ্যেতিষীদের কথা বিশ্বাস করা আল্লাহর সাথে কুফরী করার নামান্তর।
৩২.  প্রশ্ন: আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা সম্পর্কিত ইসলামের হুকুম কী?
উত্তর: আল্লাহ ছাড়া আর কারো নামে কসম বা শপথ করা জায়িয নয়। বরং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা কোনো পীর-ফকীর, বাবা-মা, ওলী-আওলিয়া, সন্তান-সন্ততি কিংবা কোনো বস্তুর নামে শপথ করা শির্ক। শপথ করতে হবে একমাত্র আল্লাহর নামে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল, সে আল্লাহর সাথে শির্ক করল।” (আহমাদ)
৩৩.  প্রশ্ন: রোগমুক্তি বা কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের ধাতু দ্বারা নির্মিত আংটি, মাদুলি, বালা, কাপড়ের টুকরা, সুতার কায়তন অথবা কুরআন মাজীদের আয়াতের নম্বর জাফরানের কালি দিয়ে লিখে এবং বিভিন্ন ধরনে নকশা এঁকে দো‘আ, তাবীয-কবয বানিয়ে তা হাতে, কোমরে, গলায় বা শরীরের কোনো অঙ্গে ব্যবহার করা যাবে কী?
উত্তর: রোগ-ব্যাধি হতে মুক্তি পাওয়ার জন্যে, মানুষের বদনযর হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে অথবা কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত বস্তুসমূহ শরীরের কোনো অঙ্গে ঝুলানো সুস্পষ্ট শির্ক বা তাওবাহ ব্যতীত অমার্জনীয় পাপ। আল্লাহ বলেন:
﴿ وَإِن يَمۡسَسۡكَ ٱللَّهُ بِضُرّٖ فَلَا كَاشِفَ لَهُۥٓ إِلَّا هُوَۖ ﴾ [الانعام: ١٧]
“আল্লাহ যদি আপনার উপর কোনো কষ্ট ও বিপদ-আপদ আরোপ করেন, তাহলে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তা দূর করতে পারে না।” [সূরা আল-আন‘আম ৬:১৭]
উল্লিখিত বিপদ-আপদে আমাদের করণীয় বিষয় দু’টি:
১. বৈধ ঝাড়ফুঁক বা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত দো‘আ পাঠ করা।
২. বৈধ বা হালাল ঔষধ সেবন করা।
এক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من علق تميمة فقد أشرك»
“যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলাল সে শিরক (তাওবাহ ব্যতীত অমার্জনীয় পাপ) করল।” (মুসনাদে আহমাদ হা: ১৬৭৮১, সিলসিলাহ সহীহাহ হা: ৪৯২, সনদ সহীহ)
৩৪. প্রশ্ন: আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় বা পন্থা কী?
উত্তর: আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্যে আমাদের সামনে মৌলিক তিনটি বিষয় রয়েছে:
১. বিভিন্ন সৎ ‘আমল দ্বারা: আল্লাহ বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ﴾ [المائ‍دة: ٣٥]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং (সৎ আমল দ্বারা) তাঁর সান্নিধ্য অন্বেষণ করো।” [সূরা আল-মায়িদাহ্ ৫:৩৫]
২. আল্লাহর সুন্দরতম ও গুণবাচক নামসমূহের দ্বারা:
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
“আর আল্লাহর জন্যে সুন্দর সুন্দর ও ভালো নাম রয়েছে, তোমরা তাঁকে সে সব নাম ধরেই ডাকবে।” [সূরা আল-আ‘রাফ ৭:১৮০]
৩. নেক্কার জীবিত ব্যক্তিদের দো‘আর মাধ্যমে: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۗ ﴾ [محمد: ١٩]
“(হে রাসূল!) আপনি প্রথমে আপনার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য, এরপর নারী ও পুরুষ সকলের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” [সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৯]
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মৃতব্যক্তি বা কোনো ওলী-আওলিয়ার মাযারে যাওয়া, আবেদন নিবেদন করা শিরক বা অমার্জনীয় পাপ।
৩৫. প্রশ্ন: ধর্মীয় ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য দেখা দিলে, তার ফায়সালা কীভাবে করতে হবে?
উত্তর: ধর্মীয় ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য দেখা দিলে, তার ফায়সালার জন্য আল্লাহর পবিত্র কুরআন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহীহ হাদীসের ফায়সালার দিকে ফিরে যেতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩﴾ [النساء: ٥٩]
“অতঃপর যদি তোমাদের মাঝে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে ফায়সালার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (ফায়সালার) দিকে ফিরে যাবে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাকো।” [সূরা আন-নিসা ৪:৫৯]
৩৬. প্রশ্ন : আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কিয়ামাত দিবসে কেউ কারো জন্যে শাফায়াত বা সুপারিশ করতে পারবে কী?
উত্তর: আল্লাহ বলেন,
﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥]
“এমন কে আছে যে, তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে?” [সুরা আল-বাক্বারাহ্ ২: ২৫৫]
﴿قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ﴾ [الزمر: ٤٤]
“বলুন! সমস্ত শাফা‘আত কেবলমাত্র আল্লাহরই ইখতিয়ারভুক্ত।” [সূরা আয-যুমার ৩৯: ৪৪]
﴿لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ لَّعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ٥١﴾ [الانعام: ٥١]
‘‘সে দিন তাদের অবস্থা এমন হবে যে, আল্লাহ ছাড়া তাদের কোনো সাহায্যকারী বন্ধু এবং কোনো সুপারিশকারী থাকবে না।” [সূরা আল-আন‘আম ৬:৫১]
৩৭. প্রশ্ন : ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করার চূড়ান্ত পরিণাম ও পরিণতি কী?
উত্তর: আল্লাহ বলেন: ‘‘আর যে কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করবে তার পরিণতি হবে জাহান্নাম, সেথায় সে সদা অবস্থান করবে এবং আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ ও তাকে অভিশপ্ত করেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [সুরা আন-নিসা ৪:৯৩]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: একজন মুমিন ব্যক্তি তার দীনের ব্যাপারে পূর্ণভাবে সুযোগ-ছাড়ের মধ্যে থাকে, যদি না সে কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে হত্যা করে। (সহীহ বুখারী: ৬৮৬২)
৩৮. প্রশ্ন: মানবরচিত আইন দ্বারা বিচার-ফায়সালা করার শার‘ঈ বিধান কী?
উত্তর: মানবরচিত আইন দ্বারা বিচার করার অর্থ হলো: আল্লাহর আইনের উপর মানবরচিত আইনকে প্রাধান্য দেওয়া। ফলে তা শির্ক বলেই গণ্য হবে। আল্লাহ বলেন:
﴿ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗاۖ﴾ [التوبة: ٣١]
‘‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের মধ্যকার পন্ডিত-পুরোহিতদেরকে প্রভু (বিচারক) বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র ঈসাকেও। অথচ তাদেরকে কেবল এ আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করবে।” [সূরা আত-তাওবাহ্ ৯:৩১]
এ সম্পর্কে সূরা আল-মায়িদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন:
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে হুকুম প্রদান করে না, এমন ব্যক্তিরা তো কাফির”
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে হুকুম প্রদান করে না,  এমন ব্যক্তিগণ তো অত্যাচারী।”
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে হুকুম প্রদান করে না, তবে তো এরূপ লোকই ফাসিক।”
৩৯. প্রশ্ন: অনেকেই মনে করে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণই প্রদান করে থাকে- প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কে প্রদান করে থাকেন?
উত্তর: মানুষের সম্মান-অসম্মান, মান-মর্যাদা,কল্যাণ-অকল্যাণ সকল কিছু চাবিকাঠি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া ওয়া তা‘আলার হাতে। তিনিই সকল শক্তি ও সার্বভৌম ক্ষমতার আধার এবং তিনিই তার বান্দাকে ক্ষমতা প্রদান করে থাকেন। জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস- এমন ধারণা বা বিশ্বাস করার অর্থ হলো, শির্কী পাপে নিজেকে নিমজ্জিত করা। আল্লাহ বলেন:
﴿وَٱللَّهُ يُؤۡتِي مُلۡكَهُۥ مَن يَشَآءُۚ﴾ [البقرة: ٢٤٧]
‘‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর রাজত্ব প্রদান করেন।” [সূরা আল-বাকারা ২:২৪৭]

সমাপ্ত
শাইখ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী
শাইখ মুহাম্মাদ আবদুন নূর মাদানী
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

সালাত ত্যাগকারীর প্রতি শরীয়তের বিধান

প্রশ্ন ১: আমার বড় ভাই তিনি সালাত পড়েন না, এ কারণে আমি কি তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব, না সম্পর্ক ছিন্ন করবো? প্রকাশ থাকে যে, তিনি আমার সৎ ভাই (বিমাতার ছেলে)।

উত্তর ১:
যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত পরিত্যাগ করে, যদি সে সালাত ওয়াজিব হওয়ার (অপরিহার্যতার) বিষয়টি স্বীকার করে, তবে ওলামাদের -দু’টি মতের সবচেয়ে সহীহ- মত অনুযায়ী সে বড় কুফরী করবে। আর যদি সালাত ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারকারী-অবিশ্বাসী হয়, তা হলে ওলামাদের সর্বসম্মত মতে সে কাফের হয়ে যাবে। এ সম্পর্কে নাবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এরশাদ হলো :
رَأْسُ الْأَمْرِ الْإِسْلاَمُ؛ وَعَمُوْدُهُ الصَّلاَةُ؛ وَذُرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ ِفيْ سَبِيْلِ اللَّهِ
“কর্মের মূল হচ্ছে ইসলাম, তার স্তম্ভ হচ্ছে সালাত এবং তার সর্বোচ্চ চূড়া হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বা সংগ্রাম করা।” [হাদীসটি ইমাম আহমাদ, তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন]

নাবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আরো এরশাদ হলো,

(( بَيْنَ الرَّجُلِ وَالْكُفْرِ وَالشِّرْكِ تَرْكُ الصَّلاَةِ ))
“ব্যক্তি এবং শিরক ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত ছেড়ে দেয়া।” [মুসলিম]
নাবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেন :
(( اَلْعَهْدُ الَّذِيْ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمُ الصَّلاَةُ فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ ))
“আমাদের এবং তাদের (কাফেরদের) মধ্যে যে প্রতিশ্রুতি, তা হলো সালাত। অতএব যে সালাত ছেড়ে দিল সে কুফরী করল।” [হাদীসটি ইমাম আহমাদ এবং আহলে সুনান সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন]
•সালাত ত্যাগ করা কুফরী, এর কারণ হলো যে, যে ব্যক্তি সালাত ওয়াজিব হওয়া অস্বীকার করে সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল, আহলে ইলম ও ঈমান এর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। যে ব্যক্তি অলসতা করে সালাত ছেড়ে দিল তার থেকে উক্ত ব্যক্তির কুফরী খুবই মারাত্বক। উভয় অবস্থাতেই মুসলিম শাসকগণের প্রতি অপরিহার্য হলো যে, তারা সালাত ত্যাগকারীদেরকে তাওবাকরার নির্দেশ দিবে, যদি তওবাহ না করে,তা হলে এ’বিষয়ে বর্ণিত দলীলের ভিত্তিতে তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করবে।
অতএব সালাত ত্যাগকারীকে বর্জন করা এবং তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ওয়াজিব এবং সালাত ত্যাগ করা থেকে আল্লাহর কাছে তওবাহ না করা পর্যন্ত তার দা’ওয়াত গ্রহণ করা যাবে না। সাথে সাথে তাকে ন্যায়ের পথে আহ্বান ও নসিহত প্রদান করা ওয়াজিব এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সালাত ত্যাগ করার কারণে যে শাস্তি তার প্রতি নির্ধারিত আছে তা থেকে সাবধান করতে হবে। এর ফলে হয়তো বা সে তাওবা করতে পারে এবং আল্লাহ পাক তার তওবাহ কবুলও করতে পারেন।
ফাতওয়া প্রদানে : মাননীয় শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, (রাহেমাহুল্লাহ) “ফাতাওয়া ওলামাইল বালাদিল হারাম” নামক কিতাব থেকে সংগৃহীত। পৃ – ১৪৫
প্রশ্ন ২: কোন ব্যক্তি যদি তার পরিবার-পরিজনকে সালাত পড়ার জন্য নির্দেশ দেয়, কিন্তু তারা তার নির্দেশের প্রতি যদি কোন গুরুত্ব না দেয়, তা হলে সে তার পরিজনের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করবে? সে কি তাদের সাথে [এক সাথে] বসবাস এবং মিলে মিশে থাকবে, না কি সে বাড়ী থেকে অন্যত্র চলে যাবে ?
উত্তর ২:
এ সমস্ত পরিবার যদি একেবারেই সালাত না পড়ে, তা হলে তারা অবশ্যই কাফের, মুরতাদ (স্বধর্মত্যাগী) ও ইসলাম থেকে খারিজ-বহির্র্ভূত হয়ে যাবে এবং উক্ত ব্যক্তির জন্য তাদের সাথে একই সংগে অবস্থান এবং বসবাস করা জায়েয নয়। তবে তাদেরকে [সংশোধনের জন্য] দাওয়াত বা আহ্বান করা তার প্রতি ওয়াজিব। বিনয় এবং প্রয়োজনে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে বারবার সালাত পড়ার জন্য আহ্বান জানাতে হবে। এর ফলে হয়তো আল্লাহ পাক তাদেরকে হিদায়েত দান করতে পারেন, কারণ সালাত ত্যাগকারী কাফের। আল্লাহ পাক [এ’থেকে] রক্ষা করুন।
এ বিষয়ে আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত বা হাদীস ও সাহাবায়ে কিরামের উক্তি এবং সঠিক বিবেচনা-পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা হলো।
প্রথমে পবিত্র কুরআন থেকে প্রমাণ :
আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের সম্পর্কে এরশাদ করেন :
] فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ[
“অতএব যদি তারা তাওবা করে নেয় এবং সালাত পড়তে থাকে ও যাকাত দিতে থাকে, তবে তারা তোমাদের ধর্মের দিক দিয়ে ভাই হয়ে যাবে; আর আমি জ্ঞানী লোকদের জন্যে বিধানাবলী বিস্তারিত বর্র্ণনা করে থাকি।” [সূরা আত তাওবাহ : ১১]
আয়াতের অর্থ থেকে বোঝা যায় যে, যদি তারা উক্ত কাজগুলো না করে, তা হলে তারা আমাদের [মুসলমানদের] ভাই নয়। তবে গোনাহ যত বড়ই হোক না কেন, গোনাহর কারণে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হবে না। কিন্তু ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার কারণে ঈমানী বন্ধন শেষ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে হাদীস থেকে প্রমাণ :
নাবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন :
(( بَيْنَ الرَّجُلِ وَالْكُفْرِ وَالشِّرْكِ تَرْكُ الصَّلاَةِ ))
“ব্যক্তি এবং শিরক ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত ছেড়ে দেয়া।” [মুসলিম]
এ সম্পর্কে হাদীসের সুনান গ্রন্থগুলিতে আবু বোরায়দাহ রা. নাবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন :
(( اَلْعَهْدُ الَّذِيْ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمُ الصَّلاَةُ فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ ))
“আমাদের এবং তাদের (কাফেরদের) মধ্যে যে প্রতিশ্রুতি তা হলো সালাত, অতএব যে সালাত ছেড়ে দিল সে কুফরী করল।” [হাদীসটি ইমাম আহমাদ এবং আহলে সুনান সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।]
সাহাবায়ে কিরামের উক্তি :

[ক] আমীরুল মুমিনিন উমার রা. বলেন :
(( لاَحَظَّ فِي الْإِسْلاَمِ لِمَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ ))
“যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিল তার ইসলামে কোন অংশ নেই।”
اَلْحَظُّ) ) ‘আল্‌ হায্‌যু’ শব্দটি এ স্থানে নাকেরাহ বা অনির্দিষ্ট, যা না বাচক বর্ণনা প্রসংগে ব্যবহার হওয়ার ফলে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সালাত ত্যাগকারীর ইসলামে তার কম এবং বেশি কোনই অংশ নেই।
[খ] আব্দুল্লাহ বিন শাকীক [রাহেমাহুল্লাহ] বলেন :
নাবী কারীম সা. এর সাহাবাগণ সালাত ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোন আমলকে কুফরী মনে করতেন না।
সঠিক বিবেচনার দিক থেকে :
প্রশ্ন হলো এটা কি কোন জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার কথা হতে পারে যে, কোন এক ব্যক্তির অন্তরে যদি সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকে এবং সে নামাযের মহত্ত্ব ও মর্যাদা বোঝে এবং আল্লাহ পাক নামাযের যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তাও সে জানে, এর পরেও কি সে সালাতকে লাগাতর ছেড়ে দিতে পারে? … এটি কখনই সম্ভব হতে পারে না। যারা বলেন যে [ সালাত ত্যাগ করার কারণে] সে কুফরী করবে না, তারা যে সমস্ত দলীলের ভিত্তিতে বলে থাকেন, আমি তাদের দলীলগুলো গভীর ভাবে চিন্তা ও গবেষণা করে দেখেছি যে, তাদের ঐ সমস্ত দলীল ও প্রমাণ পাঁচ অবস্থার বাইরে নয়।
[১] হয়তো বা উক্ত দলীলগুলো দলীল হিসেবে মূলত: গ্রহণীয় নয়।
[২] অথবা তাদের ঐ সমস্ত দলীল কোন অবস্থা অথবা বিশেষ বৈশিষ্টের সাথে শর্তযুক্ত ও সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে তাকে সালাত ত্যাগ করতে বাধা প্রদান করে থাকে।
[৩] অথবা কোন অবস্থার সাথে শর্তযুক্ত করে দেয়া হয়েছে, যারা সালাত ত্যাগ করে তাদের পক্ষে ওজর ও কৈফিয়ত হিসেবে পেশ করা হয়।
[৪] অথবা দলীলগুলো আম বা ব্যাপক, সালাত ত্যাগকারীর কুফরীর হাদীস দ্বারা তা খাস বা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
[৫] কিংবা ঐ সমস্ত দলীল দূুর্বল যা প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণীয়।
এ কথা যখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সালাত ত্যাগকারী কাফের, তাই অবশ্যই তার প্রতি মুরতাদের হুকুম বর্তাবে। এবং নুসূস বা কুরআন ও হাদীসে এমন কোন প্রমাণ নেই যে, সালাত ত্যাগকারী মুমিন অথবা সে জান্নাতে প্রবেশ করবে অথবা সে জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে, ইত্যাদি। যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে সালাত ত্যাগকারীর কুফরীকে তাবীল বা অপব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, সে নিম্নতর কুফরীতে লিপ্ত হবে।
সালাত ত্যাগকারীর প্রতি শরীয়তের বিধান
প্রথম : তাকে (কোন মুসলিম মহিলার সাথে) বিবাহ দেয়া শুদ্ধ হবে না। সালাত না পড়া অবস্থায় যদি তার আক্‌দ বা বিবাহ সম্পাদন করা হয়, তা হলেও তার নিকাহ বা বিবাহ বাতিল বলে গণ্য হবে। এবং এই বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে উক্ত স্ত্রী স্বামীর জন্য হালাল হবে না। আল্লাহ পাক [মক্কা থেকে মদীনায়] মুহাজির মহিলাদের সম্পর্কে এরশাদ করেন :
] فَإِنْ عَلِمْتُمُوهُنَّ مُؤْمِنَاتٍ فَلَا تَرْجِعُوهُنَّ إِلَى الْكُفَّارِ لَا هُنَّ حِلٌّ لَّهُمْ وَلَا هُمْ يَحِلُّونَ لَهُنَّ [
“যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মুমিন নারী, তবে তাদেরকে কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠিয়ে দিও না। মুমিন নারীরা কাফিরদের জন্যে বৈধ নয় এবং কাফিররা মুমিন নারীদের জন্যে বৈধ নয়।” [সূরা মুমতাহিনাহ্‌ : ১০]
দ্বিতীয় : বিবাহ বন্ধন সম্পাদন হওয়ার পর যদি সে সালাত ত্যাগ করে, তা হলেও তার বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে এবং পূর্র্বে যে আয়াত আমরা উল্লেখ করেছি সে আয়াতের নির্দেশ মোতাবেক স্ত্রী তার জন্য হালাল হবে না। এ বিষয়ে আহলে ইলমদের নিকট ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রসিদ্ধ রয়েছে। বিবাহ বাতিল হওয়ার ব্যাপারে স্ত্রী মিলনের আগে হোক বা পরে হোক এতে কোন পার্থক্য নেই।
তৃতীয় : যে ব্যক্তি সালাত পড়ে না, তার জবাইকৃত পশু খাওয়া যাবে না। কেন তার জবেহকৃত পশু খাওয়া যাবে না? .. এর কারণ হলো যে, উক্ত জবেহকৃত পশু হারাম। [অথচ] যদি কোন [আহলে কিতাব] ইহূদী অথবা খৃষ্টান জবাই করে তা আমাদের জন্য খাওয়া হালাল। আল্লাহ রক্ষা করুন। উক্ত সালাত ত্যাগকারীর কুরবানী ইহূদী এবং নাসারার কুরবানী থেকেও নিকৃষ্ট।
চতুর্থ : অবশ্যই তার জন্য মক্কা এবং হারামের সীমানায় প্রবেশ করা হালাল নয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার বাণী :
] يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلاَ يَقْرَبُواْ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَذَا [
“হে মুমিনগণ! মুশরিকরা হচ্ছে একেবারেই অপবিত্র, অতএব তারা যেন এ বছরের পর মসজিদুল হারামের নিকটেও আসতে না পারে।” [সূরা তাওবাহ ২৮ আয়াত]
পঞ্চম : উক্ত সালাত ত্যাগকারী ব্যক্তির যদি কোন নিকটাত্মীয় বা জ্ঞাতি মারা যায়, তা হলে সে সম্পত্তির কোন মীরাছ পাবে না। যেমন: কোন ব্যক্তি যদি এমন সন্তান রেখে মারা গেল, যে সালাত পড়ে না (উক্ত মুসলিম ব্যক্তি সালাত পড়ে এবং ছেলেটি সালাত পড়ে না) এবং তার অন্য এক দূরবর্তী চাচাতো ভাই (স্বগোত্র ব্যক্তি-জ্ঞাতি) এই দু’জনের মধ্যে কে মীরাছ পাবে? উক্ত মৃত ব্যক্তির দূরবর্তী চাচাতো ভাই ওয়ারিছ হবে, তার ছেলে কোন কিছুর ওয়ারিস হবে না। এ সম্পর্র্কে ওসামা বর্র্ণিত হাদীসে নাবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী উল্লেখ্য :
(( لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ وَلاَ الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ )) متفق عليه
“মুসলিম কাফেরের ওয়ারিছ হবে না এবং কাফের মুসলিমের ওয়ারিস হবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
((أَلْحِقُوْا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَلِأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ )) متفق عليه
“ফারায়েজ তাদের মৌল মালিকদের সাথে সংযোজন করো। অর্থাৎ সর্ব প্রথম তাদের অংশ দিয়ে দাও যাদের অংশ নির্ধারিত। অতঃপর যা অবশিষ্ট থাকবে তন্মধ্যে (মৃতের) নিকটতম পুরুষ আত্মীয়দেরই হবে অগ্রাধিকার।” [বুখারী ও মুসলিম]
এটি একটি উদাহরণ মাত্র এবং একই ভাবে অন্যান্য ওয়ারিসদের প্রতিও এই হুকুম প্রয়োগ করা হবে।
ষষ্ট : সে মারা গেলে তাকে গোসল দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, দাফনের জন্য কাফন পরানো হবে না এবং তার উপর জানাযার সালাতও পড়া হবে না এবং মুসলমানদের কবরস্থানে দাফনও করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো যে উক্ত মৃত ব্যক্তিকে আমরা কি করবো? এর উত্তর হলো যে, আমরা তার মৃতদেহকে মরুভূমিতে (খালি ভূমিতে) নিয়ে যাবো এবং তার জন্য গর্ত খনন করে তার পূর্বের পরিধেয় কাপড়েই দাফন-কবরস্থ করবো। কারণ ইসলামে তার কোন পবিত্রতা ও মর্যাদা নেই। তাই কারো জন্যে বৈধ নয় যে, যার সম্পর্কে সে জানে যে সে সালাত পড়তো না, এমন কেউ মারা গেলে মুসলমানদের কাছে জানাযার নামাযের জন্য তাকে উপস্থাপন করা।
সপ্তম : কিয়ামতের দিন ফিরআউন, হামান, কারূন এবং উবাই ইবনে খালাফ কাফেরদের নেতা ও প্রধানদের সাথে তার হাশর-নাশর হবে। আল্লাহ রক্ষা করুন। সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার পরিবার ও পরিজনের তার জন্য কোন রহমত ও মাগফিরাতের দু’আ বৈধ নয়। কারণ সে কাফের, মুসলমানদের প্রতি তার কোন হক বা অধিকার নেই। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার বাণী :
] مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَن يَسْتَغْفِرُواْ لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُواْ أُوْلِي قُرْبَى مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ [ (১১৩) سورة التوبة
“নবী এবং অন্যান্য মুমিনদের জন্য জায়েয নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্র্থনা করে। যদিও তারা আত্মীয়ই হোক না কেন, একথা প্রকাশ হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী।” [ সূরা তাওবাহ : ১১৩ আয়াত]
প্রিয় ভাই সকল ! বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং ভয়াবহ :
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, কোন কোন মানুষ বিষয়টিকে অবহেলা করে খুবই খাট করে দেখছে। এবং যারা সালাত পড়ে না তাদেরকে একই বাড়ীতে থাকার স্থান করে দিচ্ছে। অথচ এটা জায়েয নয়। আল্লাহই ভাল জানেন।
আমাদের প্রিয় নাবী, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর সাহাবাগণের প্রতি দরূদ ও ছালাম বর্ষিত হোক।
ফাতওয়া প্রদানে :
মাননীয় শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল ওসাইমীন (রাহেমাহুল্লাহ) “ফাতাওয়া ওলামাইল বালাদিল হারাম” নামক কিতাব থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৯
নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সালাত ত্যাগের এটিই হলো বিধান। আমি সেই সমস্ত ভাইদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি, যারা সালাত ছেড়ে দিয়েছে এবং সালাত ছাড়াকে সহজ মনে করছে। তুমি তোমার বাকি জীবনটা ভাল আমল করে পূর্বের আমলের ক্ষতিপূরণ ও সংশোধন করে নিবে। তুমি অবগত নও যে, তোমার বয়সের আর কত বাকী আছে। তা কি কয়েক মাস, কয়েক দিন অথবা কয়েক ঘন্টা? এ বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর কাছে। সব সময় নিম্নলিখিত আল্লাহর বাণীর কথা স্মরণ করবে।
]إِنَّهُ مَن يَأْتِ رَبَّهُ مُجْرِمًا فَإِنَّ لَهُ جَهَنَّمَ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيى [ (৭৪) طـه
“যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্যে তো আছে জাহান্নাম, সেখানে সে মরবেও না, বাঁচবেও না।” [সূরা ত্বাহা :৭৪ আয়াত]
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন :
] فَأَمَّا مَن طَغَى (৩৭) وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (৩৮) فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى[ (৩৯)
“অনন্তর যে সীমালংঘন করে, এবং পার্র্থিব জীবনকে বেছে নেয়, জাহান্নামই হবে তার অবস্থিতি স্থান।” [সূরা আন নাযি’আত ৩৮-৩৯ আয়াত]
আল্লাহ যেন তোমাকে প্রতিটি ভাল ও নাজাতের কাজের তাওফীক দান করুন এবং তিনি যেন তোমাকে বাকি দিনগুলো শরীয়তের ছায়া এবং আশ্রয়ে থেকে দাওয়াত, ইলম, আমল, সুখ, সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যময় রাখেন।
সমাপ্ত
লেখক: আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহ.
মুহাম্মদ বিন সালেহ আল ওসাইমীন রহ.
تأليف : عبد العزيز بن عبد الله بن باز رحمه الله
محمد صالح العثيميين رحمه الله
অনুবাদক: আব্দুন্‌ নূর বিন আব্দুল জব্বার
ترجمة: عبد النور بن عبد الجبار
সম্পাদনা: কাউসার বিন খালিদ
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض

শিরকের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

শিরকের সংজ্ঞা: রব ও ইলাহ হিসাবে আল্লাহর সহিত আর কাউকে শরীক সাব্যস্ত করার নামই শিরক।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে উলুহিয়াত তথা ইলাহ হিসাবে আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়। যেমন আল্লাহর সাথে অন্য কারো নিকট দোয়া করা কিংবা বিভিন্ন প্রকার ইবাদাত যেমন যবেহ, মান্নাত, ভয়, আশা, মহব্বত ইত্যাদির কোন কিছু গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা।
নিম্নলিখিত কারণে শিরক সবচেয়ে বড় গোনাহ হিসাবে বিবেচিত:
১. এতে ‘ইলাহ’- এর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যে খালেক তথা সৃষ্টিকর্তার সাথে মাখলুক তথা সৃষ্ট বস্তুর তুলনা করা হয়। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করলো, সে প্রকারান্তরে তাকে আল্লাহর অনুরূপ ও সমকক্ষ বলে স্থির করলো। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ﴿১৩﴾ سورة لقمان
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়।'[১]
জুলুম বলা হয় কোন বস্তুকে তার আসল জায়গা থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় রাখা। সুতরাং যে গায়রুল্লাহর ইবাদত করে, সে মূলত: ইবাদাতকে তার আসল স্থানে না রেখে ইবাদাত পাওয়ার উপযুক্ত নয় এমন কারো উদ্দেশ্যে তা নিবেদন করে। আর এটা হল সবচেয়ে বড় জুলুম এবং অন্যায়।

২. আল্লাহ তাআলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছেন, শিরক করার পর যে ব্যক্তি তা থেকে তওবা করবেনা, তিনি তাকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ বলেন:
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ﴿৪৮﴾ سورة النساء
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর তাঁর সাথে শরীক করার পাপ ক্ষমা করেন না। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ তিনি ক্ষমা করেন, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। ‘[২]
৩. আল্লাহ এও বলেনওয, তিনি মুশরিকদের জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন এবং তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে অবস্থান করবে। তিনি বলেন:
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ ﴿৭২﴾ سورة المائدة
‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।'[৩]
৪. শিরক সকল আমরকে নষ্ট ও নিষ্ফল করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿৮৮﴾ سورة الأنعام
‘যদি তারা শিরক করত, তবে তাদের কাজকর্ম নিষ্ফল হয়ে যেত।'[৪]
আল্লাহ আরো বলেন:
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ ﴿৬৫﴾ سورة الزمر
‘আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন।'[৫]
৫. মুশরিক ব্যক্তির রক্ত (তথা প্রাণ সংহার) ও ধন-সম্পদ কেড়ে নেয়া উভয়ই হালাল। আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ ﴿৫﴾ سورة التوبة
‘অতঃপর মুশরিকদেরকে হত্যা কর যেখানে তাদের পাও, তাদেরকে বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক।'[৬]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أمِرْتُ أنْ أقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُوْلُوْا لَاإلَهَ إلَّا الله، فإذَا قَالُوْاهَا عَصَمُوْا مِنِّي دِمَاءهُم وَأمْوَالَهُم إلَّا بِحَقِّهَا
‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন হক মা’বুদ নাই, একথা বলা পর্যন্ত লোকজনের সাথে লড়ে যাওয়ার জন্য আমাকে আদেশ করা হয়েছে। অতঃপর যখনই তারা এই বাণী উচ্চরণ করল, আমার হাত থেকে তাদের জান-মাল তারা রক্ষা করে নিল। অবশ্য এ বাণীর দাবী অনুযায়ীকৃত দন্ডনীয় অপরাধের সাজা পেতেই হবে।'[৭]
৬. কবীরা গোনাহসমূহের মধ্যে শিরক সবচেয়ে বড় গোনাহ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
ألَا أنَبِئكُمْ بِأكْبَرِ الكَبَائرِ؟ قُلْنَا بَلَى يَارَسُوْلَ الله . قاَلَ الْإشْرَاكُ بِالله وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ.
‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহের সংবাদ দিব না? আমরা বললাম- জ্বী, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল ! তিনি বললেন: আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং পিতা- মাতার অবাধ্য হওয়া।'[৮]
আল্লামা ইবনুল কাইয়েম বলেন[৯]: আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, সমস্ত জগতের সৃষ্টি এবং এর উপর কর্তৃত্বের উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহ তাআলাকে যেন তার নাম ও গুণাবলীসহ জানা যায় ও শুধু তাঁরই ইবাদত করা হয়। তাঁর সাথে আর কারো শরীক করা না হয়। আর মানুষ যেন নিজেদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করে। ন্যায় ও ইনসাফ হলো সেই নিক্তি যদ্বারা আসমান ও জমীন প্রতিষ্ঠত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ﴿২৫﴾ سورة الحديد
‘ নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।'[১০]
এখানে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছিন যে, তিনি তাঁর রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন এবং স্বীয় গ্রন্থসমূহ নাযিল করেছেন, যাতে মানুষ ‘ক্বিসত’ তথা ইনসাফ হচ্ছে তাওহীদ। বরং তাওহীদ হচ্ছে আ’দল ও ইনসাফের মূল স্তম্ভ। পক্ষান্তরে শিরক হলো স্পষ্ট জুলুম ও অন্যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ﴿১৩﴾ سورة لقمان
‘নিশ্চয়ই শিরক একটি বড় জুলুম'[১১]
অতএব শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম এবং তাওহীদ হচ্ছে সর্বোত্তম আদল ও ইনসাফ। আর যা বিশ্ব সৃষ্টির এই উদ্দেশ্যের সবচেয়ে বেশী পরিপন্থী, তাই সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ। এ ব্যাপারে ইবনুল কাইয়েম আরো বলেন: যখন শিরকই হলো এই উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, তাই সর্বতোভাবে এটাই সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ। আল্লাহ প্রত্যেক মুশরিকের উপর জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন এবং তার জান-মাল ও পরিবার- পরিজনকে তাওহীদ পন্থীদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। তদুপরি তাদেরকে দাস হিসাবে গ্রহণ করার ও অনুমতি দিয়েছেন, কেননা তারা আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্বের কাজ আদায় করা থেকে বিরত থেকেছে। আল্লাহ মুশরিক ব্যক্তির কোন কাজ কবুল করতে, আখিরাতে তার ব্যাপারে কোন সুপারিশ গ্রহণ করতে ও তার কোন দোয়া কবুল করতে এবং তার কোন আশা বাস্তবায়ন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মুশরিক ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে সবচেয়ে অজ্ঞ। কেননা সে সৃষ্টির কাইকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করে। অথচ এ হল চূড়ান্ত অজ্ঞতা এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের জুলুম। যদিও বস্তবিকভাবে মুশরিক ব্যক্তি তার রব আল্লাহ তাআলার উপর জুলুম করেনা। বরং সে নিজের উপরই জুলুম করে থাকে।
৭. শিরক হলো এমন ত্রুটি ও দোষ যা থেকে আল্লাহ তাআলা নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করলো, সে আল্লাহর জন্য ওটাই সাব্যস্ত করলো যা থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর তাই শিরক হলো আল্লাহর পরিপূর্ণ নাফরমানী, চূড়ান্ত হঠকারিতা ও তাঁকে কষ্ট দেওয়ারই নামান্তর।
শিরকের প্রকারভেদ
শিরক দুই প্রকার:

১. শিরকে আকরার (বড় শিরক) যা বান্দাকে মিল্লাতের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। এ ধরণের শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি যদি শিরকের উপরই মৃত্যুবরণ করে, এবং তা থেকে তওবা না করে থাকে, তাহলে সে চিরস্থায়ী ভাবে দোজখে অবস্থান করবে।
শিরকে আকবর হলো গায়রুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া যে কোন ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুর উদ্দেশ্যে কোন ইবাদত আদায় করা, গায়রুল্লাহর উদ্দেশে কুরবানী করা, মান্নাত করা, কোন মৃত ব্যক্তি কিংবা জ্বিন অথবা শয়তান কারো ক্ষতি করতে পারে কিংবা কাউকে অসুস্থ করতে পারে, এ ধরনের ভয় পাওয়া, প্রয়োজন ও চাহিদা পূর্ণ করা এবং বিপদ দূর করার ন্যায় যে সব ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ক্ষমতা রাখেনা সে সব ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আশা করা।
আজকাল আওলিয়া ও বুযুর্গানে দ্বীনের কবরসমূহকে কেন্দ্র করে এ ধরনের শিরকের প্রচুর চর্চা হচ্ছে। এদিকে ইশারা করে আল্লাহ বলেন:
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهَِ ﴿১৮﴾ سورة يونس
‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্তুর ইবাদত করে, যা না তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে, না করতে পারে, কোন উপকার। আর তারা বলে, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।'[১২]

২. শিরকে আসগার (ছোট শিরক) শিরক আসগার বান্দাকে মুসলিম মিল্লাতের গন্ডী থেকে বের করে দেয়না, তবে তার একত্ববাদের আক্বীদায় ত্রুটি ও কমতির সৃষ্টি করে। এটি শিরকে আকবারে লিপ্ত হওয়ার অসীলা ও কারণ। এ ধরনের শিরক দু’প্রকার:
প্রথম প্রকার: স্পষ্ট শিরক
এ প্রকারের শিরক কথা ও কাজের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
কথার ক্ষেত্রে শিরকের উদাহরণ:
আল্লাহর ব্যতীত অন্য কিছুর কসম ও শপথ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ كَفَرَ أوْ أشْرَكَ.
‘যে ব্যক্তি গায়রুল্লার কসম করল, সে কুফুরী কিংবা শিরক করল'[১৩]
অনুরূপভাবে এমন কথা বলা যে, ”আল্লাহ এবং তুমি যেমন চেয়েছ” ماشاء الله وشئت কোন এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ”আল্লাহ এবং আপনি যেমন চেয়েছেন” কথাটি বললে তিনি বললেন, ”তুমি কি আমাকে আল্লাহর সাথে সমকক্ষ স্থির করলে? বরং বল, আল্লাহ এককভাবে যা চেয়েছেন।”[১৪]
আর একথাও বলা যে, ”যদি আল্লাহ ও অমুক ব্যক্তি না থাকত” لولا الله و فلان। উপরোক্ত ক্ষেত্রদ্বয়ে বিশুদ্ধ হল নিম্নরূপে বলা – ”আল্লাহ চেয়েছেন, অতঃপর অমুক যেমন চেয়েছে” ماشاء الله ثم فلان ”যদি আল্লাহ না থাকতেন, অতঃপর অমুক ব্যক্তি না থাকত” لولا الله ثم فلان। কেননা আরবীতে ثم (যার অর্থ: তারপর বা অতঃপর) অব্যয়টি বিলম্বে পর্যায়ক্রমিক অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই”এবং ” শব্দের বদলে “তারপর” কিংবা “অতঃপর শব্দের ব্যবহার বান্দার ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার অধীনস্ত করে দেয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ﴿২৯﴾ سورة التكوير
‘তোমরা বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুরই ইচ্ছা করতে পারনা।'[১৫]
পক্ষান্তরে আরবী واو যার অর্থ : এবং অব্যয়টি দুটো সত্ত্ব বা বস্তুকে একত্রীকরণ ও উভয়ের অংশীদারিত্ব অর্থ প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। এদ্বারা পর্যায়ক্রমিক অর্থ কিংবা পরবর্তী পর্যায়ে সংঘটিত অর্থ বুঝা যায়না। যেমন একথা বলা যে, ” আমার জন্য তো কেবল তুমি এবং আল্লাহ আছ” ও ” এতো আল্লাহ এবং তোমার বরকতে হয়েছে”।
আর কাজের ক্ষেত্রে শিরকের উদাহরণ:
যেমন বিপদাপদ দূর করার জন্য কড়ি কিংবা দাগা বাঁধা, বদনজর থেকে বাঁচার জন্য তাবীজ ইত্যাদি লটকানো। এসব ব্যাপারে যদি এ বিশ্বাস থাকে যে, এগুলো বলাথ-মসীবত দূর করার মাধ্যম ও উপকরণ, তাহলে তা হবে শিরকে আসগার। কেননা আল্লাহ এগুলোকে সে উপকরণ হিসাবে সৃষ্টি করেননি। পক্ষান্তরে কারো যদি এ বিশ্বাস হয় যে, এসব বস্তু স্বয়ং বালা- মুসীবত দূর করে, তবে তা হবে শিরক আকবর। কেননা এতে গায়রুল্লাহর প্রতি সেই ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট।
দ্বিতীয় প্রকার: গোপন শিরক
এ প্রকার শিরকের স্থান হলো ইচ্ছা, সংকল্প ও নিয়্যাতের মধ্যে। যেমন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ও প্রসিদ্ধি অর্জনের জন্য কোন আমল করা। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায় এমন কোন কাজ করে তা দ্বারা মানুষের প্রশংসা লাভের ইচ্ছা করা। যেমন সুন্দর ভাবে নামায আদায় করা, কিংবা সদকা করা এ উদ্দেশ্যে যে, মানুষ তার প্রশংসা করবে, অথবা সশব্দে যিকির- আযকার পড়া ও সুকণ্ঠে তেলাওয়াত করা যাতে তা শুনে লোকজন তার গুণগান করে। যদি কোন আমলে রিয়া তথা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য সংমিশ্রিত থাকে, তাহলে আল্লাহ তা বাতিল করে দেন। আল্লাহ বলেন:
فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا ﴿১১০﴾ سورة الكهف
‘অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে'[১৬]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أخوف ما أخاف عليكم الشرك الأصغر، قالوا يارسول الله وما الشرك الأصغر قال: الرياء
‘তোমাদের উপর আমি যে জিনিসের ভয় সবচেয়ে বিশী করছি তা হল শিরকে আসগরধ। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! শিরকে আসগর কি? তিনি বললেন: রিয়া (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা) [১৭]
পার্থিব লোভে পড়ে কোন আমল করাও এ প্রকার শিরকের অন্তর্গত। যেমন কোন ব্যক্তি শুধু মাল- সম্পদ অর্জনের জন্যেই হজ্জ করে, আযান দেয় অথবা লোকদের ইমামতি করে, কিংবা শরয়ী জ্ঞান অর্জন করে বা জিহাদ করে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
تعس عبد الدينار و تعس عبد الدرهم، تعس عبد الخميصة، تعس عبدالخميلة إن أعطي رضي إن لم يعط سخط.
‘ দীনার, দিরহাম এবং খামিসা- খামিলা (তথা উত্তম পোশক-পরিচ্ছদ- এর যারা দাস, তাদের ধ্বংস। তাকে দেয়া হলে সে সন্তুষ্ট হয়, আর না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। ‘[১৮]
ইমাম ইবনুল কাইয়েম র. বলেন সংকল্প ও নিয়্যাতের শিরক হলো এমন এক সাগর সদৃশ যার কোন কূল- কিনারা নেই। খুব কম লোকই তা থেকে বাঁচতে পারে। অতএব যে ব্যক্তি তার আমল দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু ও গায়রুল্লার কাছে ঐ আমলের প্রতিদান প্রত্যাশা করে, সে মূলতঃ উক্ত আমল দ্বারা তার নিয়ত ও সংকল্প নিয়্যত খালেছ ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে করা। এটাই হলো সত্যপন্থা তথা ইব্রাহীমের মিল্লাত, যা অনুসরণ করার জন্য আল্লাহ তাঁর সকল বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এতদ্ব্যতীত তিনি কারো কাছ থেকে অন্য কিছু কবুল করবেন না। আর এ সত্য পন্থাই হলো ইসলামের হাকীকত।
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ﴿৮৫﴾ آل عمران
‘কেহ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবেনা এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত। ‘[১৯]
উপরের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বাবে বুঝা যাচ্ছে যে, শিরকে আকবার ও শিরকে আসগারের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
সেগুলো হল:
১. কোন ব্যক্তি শিরকে আকবারে লিপ্ত হলে সে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয়ে যায়। পক্ষান্তরে শিরকে আসগারের ফলে সে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয় না।
২. শিরকে আকবরে লিপ্ত ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে অবস্থান করবে। পক্ষান্তরে শিরকে আসগারে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামে গেলে চিরকাল সেখানে অবস্থান করবেনা।
৩. শিরকে আকবার বান্দার সমস্ত আমল নষ্ট করে দেয়, কিন্তু শিরকে আসগার সব আমল নষ্ট করেনা। বরং রিয়া ও দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃত আমল শুধু তৎসংশ্লিষ্ট আমলকেই নষ্ট করে।
৪. শিরকে আকবারে লিপ্ত ব্যক্তির জান-মাল মুসলমানদের জন্য হালাল। পক্ষান্তরে শিরকে আসগারে লিপ্ত ব্যক্তির জান-মাল কারো জন্য হালাল নয়।
সমাপ্ত
 
তথ্যসূত্রঃ
[১] সূরা লুকমান, ১৩।
[২] সূরা নিসা, ৪৮।
[৩] সুরা মায়িাদা, ৭২।
[৪] সূরা আন আম, ৮৮।
[৫] সূরা যুমার, ৬৫।
[৬] সূরা তাওবা, ০৫।
[৭] বুখারী, মুসলিম।
[৮] বুখারী, মুসলিম।
[৯] আল জাওয়াব আলকাফী,১০৯।
[১০] সুরা হাদীদ, ২৫।
[১১] সুরা লুকমান, ১৩।
[১২] সূরা ইউনুছ, ১৮।
[১৩] তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং হাসান বলেছেন। আর হাকেম একে সহীহ বলে অবহিত করেছেন।
[১৪] নাসায়ী।
[১৫] সূরা তাকবীর, ২৯।
[১৬] সূরা কাহাফ, ১১০
[১৭] আহমদ, তাবারানী, বাগাভী।
[১৮] বুখারী।
[১৯] আলে ইমরান, ৮৫।
_________________________________________________________________________________
লেখক : সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান
تأليف: صالح بن فوزان الفوزان
অনুবাদক : মানজুরে ইলাহী
مراجعة : منظور إلهي
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض

কোয়ান্টাম মেথড: এক ভয়াবহ শিরকী ফেতনার নাম!

এই ফেতনা বাংলাদেশের হাজারও মুসলমানকে শিরক্ কুফরী আর বিদ’আত করতে বাধ্য করছে! মেডিটেশনের আড়ালে ভন্ড গুরুজীর রমরমা ব্যবসা!!
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন বা জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।” [সূরা আল মায়েদাহ:-৩]
“সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদের আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়। প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত, আর প্রতিটি বিদআতই পথভ্রষ্টতা।” [সহীহ্ মসলিম:- ২/৫৯৩]
“যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে দ্বীন হিসাবে তালাশ করবে, তার নিকট থেকে তা কবুল করা হবেনা। আর আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [সূরা আলে ইমরান:-৮৫]
আল্লাহর বানী এত্ত স্পষ্ট হওয়ার পরেও এক জন মুসলমানের জীবনে শান্তি খুজতে কোয়ান্টাম মেথড এর সাহাজ্য নিতে হয় কেন এবং কোন সাহসে!??

কোয়ান্টাম মেথড : একটি শয়তানী ফাঁদ
মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরিয়ে কথিত অন্তর্গুরুর ইবাদতে লিপ্ত করার অভিনব প্রতারণার নাম হ’ল কোয়ান্টাম মেথড। হাযার বছর পূর্বে ফেলে আসা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান পাদ্রী ও যোগী-সন্ন্যাসীদের যোগ-সাধনার আধুনিক কলা-কৌশলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেডিটেশন’

হতাশাগ্রস্ত মানুষকে সাময়িক প্রশান্তির সাগরে ভাসিয়ে এক কল্পিত দেহভ্রমণের নাম দেওয়া হয়েছে Science of Living বা জীবন-যাপনের বিজ্ঞান। আকর্ষণীয় কথার ফুলঝুরিতে ভুলে টাকাওয়ালা সাধারণ শিক্ষিত মানুষেরা এদের প্রতারণার ফাঁদে নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছেন অবলীলাক্রমে। ব্যয় করছেন কথিত ধ্যানের পিছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঢেলে দিচ্ছেন হাযার হাযার টাকা। অথচ একটা রঙিন স্বপ্ন ছাড়া তাদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। অন্যদিকে মুসলমান যারা এদের দলে ভিড়ছে, তারা শিরকের মহাপাতকে লিপ্ত হয়ে দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিই হারাচ্ছে। নিম্নে আমরা এদের আক্বীদা-বিশ্বাস ও কর্মনীতি যাচাই করব।- কোয়ান্টামের পঞ্চসূত্র হ’ল, প্রশান্তি, সুস্বাস্থ্য, প্রাচুর্য, সুখী পরিবার ও ধ্যান। বলা হয়েছে, কোয়ান্টাম প্রত্যেকের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে। সুখী মানুষের সবটুকু প্রয়োজন পূরণের প্রক্রিয়াই রয়েছে কোয়ান্টামে। তাই কোয়ান্টামই হচ্ছে নতুন সহস্রাব্দে আধুনিক মানুষের জীবন যাপনের বিজ্ঞান’।

অন্যান্য ডিগ্রীর ন্যায় এখানকার ধ্যান সাধনায় যারা উত্তীর্ণ হয়, তাদেরকে ‘কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট’ বলে শ্রুতিমধুর একটা ডিগ্রী দেওয়া হয়। তাদের প্রচার অনুযায়ী বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং আত্মউন্নয়নে ধ্যান পদ্ধতির প্রবর্তক প্রফেসর এম.ইউ. আহমাদ নাকি ক্লিনিক্যালি ডেড হওয়ার পরেও পুনরায় জীবন লাভ করেন শুধু ‘তাঁকে বাঁচতে হবে, তিনি ছাড়া দেশে নির্ভরযোগ্য মনোচিকিৎসক নেই’ তাঁর এই দৃঢ় বিশ্বাসের জোরে’ (মহাজাতক, কোয়ান্টাম টেক্সট বুক, জানু. ২০০০, পৃঃ ২২-২৪)।
অর্থাৎ হায়াত-মউতের মালিক তিনি নিজেই।

প্রথমে বলে রাখি, মানবরচিত প্রত্যেক ধর্মেই স্ব স্ব নিয়মে ধ্যান পদ্ধতি আছে। হিন্দু-বৌদ্ধ যোগী-সন্ন্যাসীদের সাধন-ভজন সম্বন্ধে আমরা কিছুটা জানি। আল্লাহ প্রেরিত ঈসায়ী ধর্মে সর্বপ্রথম সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব হয়। যে বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
‘আর সন্ন্যাসবাদ, সেটাতো তারা নিজেরাই প্রবর্তন করেছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। আমরা তাদেরকে এ বিধান দেই নি। অথচ এটাও তারা যথাযথভাবে পালন করে নি। তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল, তাদেরকে আমরা পুরস্কার দিয়েছিলাম। আর তাদের অধিকাংশ ছিল পাপাচারী’ (হাদীদ ৫৭/২৭)।
এখানে আল্লাহ তাদেরকে দুইভাবে নিন্দা করেছেন।
. তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত অর্থাৎ নতুন রীতির উদ্ভাবন করেছিল।
২. তারা নিজেরা যেটাকে আল্লাহর নৈকট্য মনে করে আবিষ্কার করেছিল, সেটার উপরেও তারা টিকে থাকতে পারেনি। ইসলামের স্বর্ণযুগের পরে ভ্রষ্টতার যুগে মা‘রেফতের নামে বিদ‘আতী পীর-ফকীররা নানাবিধ ধ্যান পদ্ধতি আবিষ্কার করে। অতঃপর কথিত ইশক্বের উচ্চ মার্গে পৌঁছে হুয়া হু করতে করতে যখন চক্ষু ছানাবড়া হয়ে ‘কাশফ’ বা ‘হাল’ হয়, তখন নাকি তাদের আত্মা পরমাত্মার মধ্যে লীন হয়ে যায়। একে তাদের পরিভাষায় ফানা ফিল্লাহ বা বাক্বা বিল্লাহ বলে। এরাই ছূফী ও পীর-মাশায়েখ নামে এদেশে পরিচিত। অথচ এইসব মা‘রেফতী তরীকার কোন অনুমোদন ইসলামে নেই। ধ্যানকে কোয়ান্টামের পরিভাষায় বলা হয় ‘মেডিটেশন’ (Medetation)। যার প্রথম ধাপ হ’ল ‘শিথিলায়ন’ যা মনের মধ্যে ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করে। আর শেষ ধাপ হ’ল মহা চৈতন্য (Super Consciousness)। যখন তারা বস্ত্তগত সীমা অতিক্রম করে মহা প্রশান্তির মধ্যে লীন হয়ে যায়। যদিও এর কোন সংজ্ঞা তাদের বইতে সুস্পষ্টভাবে নেই। এক্ষণে কোয়ান্টামের সাথে অন্যদের পার্থক্য এই যে, অন্যেরা স্ব স্ব ধর্মের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করেছে ও স্ব স্ব ধর্মের নামেই পরিচিতি পেয়েছে। পক্ষান্তরে কোয়ান্টাম মেথড সকল ধর্ম ও বর্ণের লোকদের নতুন ধ্যানরীতিতে জমা করেছে। খানিকটা সম্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহীর মত। তখন আবুল ফযল ও ফৈযীর মত সেকালের সেরা পণ্ডিতবর্গের মাধ্যমে সেটা চালু হয়েছিল মূলতঃ রাজনৈতিক কারণে। আর এ যুগে কিছু উচ্চ শিক্ষিত সুচতুর লোকদের মাধ্যমে এটা চালু হয়েছে ইসলাম থেকে মানুষকে সরিয়ে নেবার জন্যে এবং শিক্ষিত শ্রেণীকে বিশ্বাসে ও কর্মে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ বানাবার জন্যে। যাতে ভবিষ্যতে এদেশ তার ইসলামী পরিচিতি হারিয়ে সেক্যুলার দেশে পরিণত হয়। মুনি-ঋষিরা ধ্যান করে তাদের ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের জন্য। পক্ষান্তরে কোয়ান্টামে ধ্যান করা হয় স্ব স্ব ‘অন্তর্গুরু’কে পাওয়ার জন্য। যেমন বলা হচ্ছে, ‘অন্তর্গুরুকে পাওয়ার আকাংখা যত তীব্র হবে, তত সহজে আপনি তার দর্শন লাভ করবেন। এ ব্যাপারে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েটদের’ (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪৭)। যেমন একটি ঘটনা বলা হয়েছে, ‘ছেলে কোলকাতায় গিয়েছে। দু’দিন কোন খবর নেই। বাবা কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। মাগরিবের নামাজ পড়ে মেডিটেশন কমান্ড সেন্টারে গিয়ে ছেলের বর্তমান অবস্থা দেখার চেষ্টা করতেই কোলকাতার একটি সিনেমা হলের গেট ভেসে এল। ছেলে সিনেমা হলের গেটে ঢুকছে। বাবা ছেলেকে তার উদ্বেগের কথা জানালেন। বললেন শিগগীর ফোন করতে’ (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪১)।এমনিতরো উদ্ভট বহু গল্প তারা প্রচার করেছেন।
• এক্ষণে আমরা দেখব ইসলামের সাথে এর সম্পর্ক:

১. এটি তাওহীদ বিশ্বাসের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং পরিষ্কারভাবে শিরক।
তাওহীদ বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ কেন্দ্রিক। ইসলামের সকল ইবাদতের লক্ষ্য হ’ল আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ও পরকালে মুক্তি লাভ করা। পক্ষান্তরে কোয়ান্টামের ধ্যান সাধনার লক্ষ্য হ’ল অন্তর্গুরুকে পাওয়া। যা আল্লাহ থেকে সরিয়ে মানুষকে তার প্রবৃত্তির দাসত্বে আবদ্ধ করে। এদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেন, ‘আপনি কি দেখেছেন ঐ ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহ বানিয়েছে? আপনি কি তার যিম্মাদার হবেন’?
‘আপনি কি ভেবেছেন ওদের অধিকাংশ শুনে বা বুঝে? ওরা তো পশুর মত বা তার চাইতে পথভ্রষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩-৪৪)।
মূলতঃ ঐ অন্তর্গুরুটা হ’ল শয়তান। সে সর্বদা তাকে রঙিন স্বপ্নের মাধ্যমে তার দিকে প্রলুব্ধ করে।
২. তারা বলেন, মনকে প্রশান্ত করার মতো নামাজ যাতে আপনি পড়তে পারেন সেজন্যই মেডিটেশন দরকার।
কেননা নামাজের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হুযুরিল ক্বালব, একাগ্রচিত্ততা। এটা কিভাবে অর্জিত হয়, তা এখানে এলে শেখা যায়’ (প্রশ্নোত্তর ১৪২৭)।
জবাব : এটার জন্য সর্বোত্তম পন্থা হ’ল ছালাত। এর বাইরে কোন কিছুর অনুমোদন ইসলামে নেই।
আল্লাহ বলেন,
তুমি ছালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’ (ত্বোয়াহা ১৪)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সংকটে পড়তেন তখন ছালাতে রত হ’তেন (আবুদাঊদ হা/১৩১৯)।
তিনি বলেছেন,
তোমরা ছালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে দেখছ’ (বুখারী হা/৬৩১)।
যারা খুশু-খুযুর সাথে ফরয, নফল ও তাহাজ্জুদ ছালাত নিয়মিতভাবে আদায় করে, তাদেরকেই আল্লাহ সফলকাম মুমিন বলেছেন (মুমিনূন ১-২)।
আর ছালাতে ধ্যান করা হয় না। বরং একমনে বান্দা তার সৃষ্টিকর্তার সাথে একান্তে আলাপ করে (বুখারী হা/৫৩১)।
সর্বোচ্চ শক্তির কাছে নিজের দুর্বলতা ও নিজের কামনা-বাসনা পেশ করে সে হৃদয়ে সর্বোচ্চ প্রশান্তি লাভ করে এবং নিশ্চিত আশাবাদী হয়। অথচ মেডিটেশনের কথিত অন্তর্গুরুর কোন ক্ষমতা নেই। তার সাধনায় নিশ্চিত আশাবাদের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা ওটা তো স্রেফ কল্পনা মাত্র। ছালাতে আল্লাহর ইবাদত করা হয়। পক্ষান্তরে মেডিটেশনে অন্তর্গুরুর ইবাদত করা হয়। একটি তাওহীদ, অপরটি শিরক। দু’টিকে এক বলা দিন ও রাতকে এক বলার সমান। যা চরম ধৃষ্টতার নামান্তর।
৩. তারা বলেন, কোয়ান্টাম মেডিটেশনের জন্য ধর্ম বিশ্বাস কোন যরূরী বিষয় নয়। ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের সাথে এর কোন বিরোধ নেই।
তাদের কার্যাবলীতে এর প্রমাণ রয়েছে। যেমন, ‘এখন কোয়ান্টাম শিশু কাননে রয়েছে ১৫টি জাতিগোষ্ঠীর চার শতাধিক শিশু। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রামা, খ্রিষ্টান, প্রকৃতিপূজারী সকল ধর্মের শিশুরাই যার যার ধর্ম পালন করছে। আর এক সাথে গড়ে উঠছে আলোকিত মানুষ হিসাবে’ (শিশু কানন)।
জবাব : মানুষকে সকল ধর্ম থেকে বের করে এনে কোয়ান্টামের নতুন ধর্মে দীক্ষা নেবার ও কোয়ান্টাম নেতাদের গোলাম বানানোর চমৎকার যুক্তি এগুলি।
কেননা অন্তর্গুরুর ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন, আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হতে গেলে একজন আলোকিত গুরুর কাছে বায়াত বা দীক্ষা নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া আধ্যাত্মিকতার সাধনা এক পিচ্ছিল পথ। যেকোন সময়ই পা পিছলে পাহাড় থেকে একেবারে গিরিখাদে পড়ে যেতে পারেন’ (টেক্সটবুক, পৃঃ ২৪৭)। অর্থাৎ এরা ‘আলোকিত মানুষ’ বানাচ্ছে না। বরং ইসলামের আলো থেকে বের করে এক অজানা অন্ধকারে বন্দী করছে। যার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা আল্লাহ বলেন,
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করবে, তা কবুল করা হবে না। ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৮৫)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,
আমি তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছি’ (আহমাদ, মিশকাত হা/১৭৭)।
অতএব ইসলামের প্রকৃত অনুসারীরাই কেবল আলোকিত মানুষ। বাকী সবাই অন্ধকারের অধিবাসী।
৪. তারা বলেন, বহু আলেম আমাদের মেডিটেশন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং তারা এর সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই বলেছেন।
জবাব : অল্প জ্ঞানী অথবা কপট বিশ্বাসী ও দুনিয়াপূজারী লোকেরাই চিরকাল ইসলামের ক্ষতি করেছে। আজও করছে।
ওমর (রাঃ) বলেন, ইসলামকে ধ্বংস করে তিনটি বস্ত্ত :
(১) আলেমদের পদস্খলন
(২) আল্লাহর কিতাবে মুনাফিকদের ঝগড়া এবং
(৩) পথভ্রষ্ট নেতাদের শাসন’ (দারেমী)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। অতএব যা তাঁর ও তাঁর ছাহাবীগণের আমলে দ্বীন হিসাবে গৃহীত ছিল, কেবলমাত্র সেটাই দ্বীন হিসাবে গৃহীত হবে। তার বাইরে কোন কিছুই দ্বীন নয়।
৫. মেডিটেশন পদ্ধতি নিজের উপরে তাওয়াক্কুল করতে বলে এবং শিখানো হয় যে, ‘তুমি চাইলেই সব করতে পার’। এরা হাতে মূল্যবান ‘কোয়ান্টাম বালা’ পরে ও তার উপরে ভরসা করে।
জবাব : ইসলাম মানুষকে মহাশক্তিধর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে শিখায় এবং আল্লাহ যা চান তাই হয়।
এর মাধ্যমে মুমিন নিশ্চিন্ত জীবন লাভ করে ও পূর্ণ আত্মশক্তি ফিরে পায়। আর ইসলামে এ ধরনের
‘বালা’ পরা ও তাবীয ঝুলানো শিরক (ছহীহাহ হা/৪৯২)।
৬. তারা বলেন, শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে এমন এক ক্ষমতা তৈরী হয়, যার দ্বারা সে নিজেই নিজের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারে।
এজন্য একটা গল্প বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক ইঞ্জিনিয়ার সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করার মনছবি দেখতে লাগল। ফলে সে ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। তারপর সেখানে ভাল একটা চাকুরীর জন্য মনছবি দেখতে লাগল। ফলে সেখানে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই উন্নতমানের একটা চাকুরী পেয়ে গেল’(টেক্সট বুক পৃঃ ১১৫)।
জবাব : ইসলাম মানুষকে তাকদীরে বিশ্বাস রেখে বৈধভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে বলে।
অথচ কোয়ান্টাম সেখানে আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে কথিত মনছবির পূজা করতে বলে।
৭. কোয়ান্টামের মতে রোগের মূল কারণ হ’ল মানসিক।
তাই সেখানে মনছবি বা ইমেজ থেরাপি ছাড়াও ‘দেহের ভিতরে ভ্রমণ’ নামক পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের নানা অঙ্গের মধ্য দিয়ে কাল্পনিক ভ্রমণ করতে বলা হয়। এতে সে তার সমস্যার স্বরূপ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে এবং নিজেই কম্যান্ড সেন্টারের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। যেমন, একজন ক্যান্সার রোগী তার ক্যান্সারের কোষগুলিকে সরিষার দানা রূপে কল্পনা করে। আর দেখে যে অসংখ্য ছোট ছোট পাখি ঐ সরিষাদানাগুলো খেয়ে নিচ্ছে। এভাবে আস্তে আস্তে সর্ষে দানাও শেষ, তার ক্যান্সারও শেষ’ (টেক্সট বুক পৃঃ ১৯৪)।
৮. এদের শোষণের একটি হাতিয়ার হ’ল ‘মাটির ব্যাংক’।
যে নিয়তে এখানে টাকা রাখবেন, সে নিয়ত পূরণ হবে। প্রথমবারে পূরণ না হ’লে বুঝতে হবে মাটির ব্যাংক এখনো সন্তুষ্ট হয়নি। এভাবে টাকা ফেলতেই থাকবেন। কোন মানত করলে মাটির ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। পূরণ না হলে অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এখানে খাঁটি সোনার চেইন বা হীরার আংটি দিতে পারেন। ইমিটেশন দিলে মানত পূরণ হবে না (প্রশ্নোত্তর)। এর জন্য একটা গল্প ফাঁদা হয়েছে। যেমন, ‘মধ্যরাতে উঠে মাটির ব্যাংকে পাঁচশত টাকা রাখার সাথে সাথে মুমূর্ষু ছেলে সুস্থ হয়ে গেল’ (দুঃসময়ের বন্ধু..)।

প্রিয় পাঠক! বুঝতে পারছেন, কত সুচতুরভাবে মানুষকে আল্লাহ থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের কম্যান্ড সেন্টারে আবদ্ধ করা হচ্ছে এবং সেই সাথে মাটির ব্যাংকে টাকা ও গহনা রাখার ও তা কুড়িয়ে নেবার চমৎকার ফাঁদ পাতা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রোগ ও তা আরোগ্য দানের মালিক আল্লাহ। আল্লাহর হুকুম আছে বলেই মুমিন ঔষধ খায়। ঔষধ আরোগ্যদাতা নয়। বরং আল্লাহ মূল আরোগ্যদাতা। এই বিশ্বাস তাকে প্রবল মানসিক শক্তিতে শক্তিমান করে তোলে। এজন্য তাকে মেডিটেশন বা কম্যান্ড সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মাটির ব্যাংকে টাকা রাখারও দরকার হয় না। বরং গরীবকে ছাদাক্বা দিলে তার গোনাহ মাফ হয় (মিশকাত হা/২৯)।
৯. অন্যান্য বিদ‘আতীদের ন্যায় এরাও কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করেছে মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে দলে ভিড়ানোর জন্য।
যেমন:

(ক) সকল ধর্মই সত্য’ তাদের এই মতবাদের পক্ষে সূরা কাফেরূনের ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন’ শেষ আয়াতটি ব্যবহার করেছে। যেন আবু জাহলের দ্বীনও ঠিক, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দ্বীনও ঠিক। এই অপব্যাখ্যা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকরা ও তাদের পদলেহীরা করে থাকে। কোয়ান্টামের লোকেরাও করছে। অথচ ইসলামের সারকথা একটি বাক্যেই বলা হয়েছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই। একথার মধ্যে সকল ধর্ম ও মতাদর্শকে অস্বীকার করা হয়েছে। কোয়ান্টামের অন্তর্গুরু নামক ইলাহটিকেও বাতিল করা হয়েছে।

(খ) তারা বলেন মেডিটেশন একটি ইবাদাত। যা রাসূল (ছাঃ) হেরা গুহায় করেছেন’। অথচ এটি স্রেফ তোহমত বৈ কিছু নয়। নিঃসঙ্গপ্রিয়তা আর মেডিটেশন এক নয়। তাছাড়া নবী হওয়ার পরে তিনি কখনো হেরা গুহায় যাননি। ছাহাবায়ে কেরামও কখনো এটি করেননি।

(গ) তারা সূরা জিন-এর ২৬ ও ২৭ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলেছেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গায়েবের খবর জানাতে পারেন। অতএব যে যা জানতে চায় আল্লাহ তাকে সেই জ্ঞান দিয়ে দেন’ (প্রশ্নোত্তর ১৭৫৩)।
অথচ উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর মনোনীত রাসূল ছাড়া তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারু নিকট প্রকাশ করেন না। এ সময় তিনি সামনে ও পিছনে প্রহরী নিযুক্ত করেন’। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর রাসূলের নিকট ‘অহি’ প্রেরণ করেন এবং তাকে শয়তান থেকে নিরাপদ রাখেন। এই ‘অহি’-টাই হ’ল গায়েবের খবর, যা কুরআন ও হাদীছ আকারে আমাদের কাছে মওজুদ রয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ‘অহি’-র আগমন বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব কোয়ান্টামের গুরুরা চাইলেও গায়েবের খবর জানতে পারবেন না।

(ঘ) তারা সূরা বুরূজ-এর বুরূজ অর্থ করেন ‘রাশিচক্র’।
যাতে আল্লাহকে বাদ দিয়ে রাশিচক্র অনুযায়ী মানুষের ভাল-মন্দ ও শুভাশুভ নির্ধারণের বিষয়টি তাদের শিষ্যদের মনে গেঁথে যায়। অথচ এটি হিন্দু ও তারকা পূজারীদের শিরকী আক্বীদা মাত্র।

(ঙ) তারা সূরা আলে ইমরানের ১৯১ আয়াতটি তাদের আবিষ্কৃত মেডিটেশনের পক্ষে প্রমাণ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন (প্রশ্নোত্তর ১৭৫৩)। ঐ সাথে একটি জাল হাদীছকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম’ (প্রশ্নোত্তর ১৭২৪)। অথচ উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর সৃষ্টি বিষয়ে গভীর গবেষণা তাকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনায় উদ্বুদ্ধ করে’।
কোয়ান্টামের কথিত অন্তর্গুরুর কাছে যেতে বলে না। আর হাদীছটি হ’ল জাল। যা আদৌ রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী নয়। কোন কোন বর্ণনায় ৬০ বছর ও ১০০০ বছর বলা হয়েছে’ (সিলসিলা যঈফাহ হা/১৭১)।
পরিশেষে বলব, কোয়ান্টাম মেথডের পূরা চিন্তাধারাটাই হ’ল তাওহীদ বিরোধী এবং শিরক প্রসূত। যা মানুষের মাথা থেকে বেরিয়ে এলেও এর মূল উদ্গাতা হ’ল শয়তান।
মানুষকে জাহান্নামে নেবার জন্য মানুষের নিকট বিভিন্ন পাপকর্ম শোভনীয় করে পেশ করার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন (হিজর ৩৯)।
তবে সে আল্লাহর কোন মুখলেছ বান্দাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না (হিজর ৪০)।
শয়তান নিজে অথবা কোন মানুষের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকে। যেমন হঠাৎ করে শোনা যায়, অমুক স্থানে অমুকের স্বপ্নে পাওয়া শিকড়ে বা তাবীযে মানুষের সব রোগ ভাল হয়ে যাচ্ছে। ফলে দু’পাঁচ মাস যাবত দৈনিক লাখো মানুষের ভিড় জমিয়ে হাযারো মুসলমানের ঈমান হরণ করে হঠাৎ একদিন ঐ অলৌকিক চিকিৎসক উধাও হয়ে যায়। এদের এই ধোঁকার জালে আবদ্ধ হয়েছিল সর্বপ্রথম নূহ (আঃ)-এর কওম। যারা পরে আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যায়। আমরাও যদি শিরকের মহাপাপ থেকে দ্রুত তওবা না করি, তাহ’লে আমরাও তাঁর গযবে ধ্বংস হয়ে যাব। অতএব হে মানুষ! সাবধান হও!!(স.স.)
সূত্র: মাসিক আত-তাহরীক

Hello world!

This is your very first post. Click the Edit link to modify or delete it, or start a new post. If you like, use this post to tell readers why you started this blog and what you plan to do with it.

Happy blogging!